ডেস্ক রিপোর্ট: অবশেষে পদত্যাগ করলেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর পৌঁছার পর পরই ই-মেইলে দেশটির স্পীকার বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন তিনি। এ খবরে কলম্বোর প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। কার্ফু অমান্য করে উৎসবে মেতে ওঠে তারা। ১৯৭৮ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম দেশটির কোন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলেন। আজ শুক্রবার এই পদত্যাগের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার কথা। স্পীকারের দফতর এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত সিঙ্গাপুর দূতাবাসের মাধ্যমে গোতাবায়ার পদত্যাগপত্র পেয়েছেন। তবে আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি ঘোষণা করা হবে। এদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন দেশটির সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রথম ফিল্ড মার্শাল শরৎ ফনসেকা। তামিল টাইগারদের পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ফনসেকা বলেন, পদুজানা পেরামুনা দলের একটি বড় অংশ এবং অন্যান্য দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা আমাকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার অনুরোধ করেছেন। নির্বাচিত হলে আমি এ দায়িত্ব পালনে রাজি। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ফনসেকা। খবর এএফপি ও বিবিসির। শ্রীলঙ্কানদের ক্ষোভ এখন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের দিকে ঘুরে গেছে। দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুধবার রনিলের নাম ঘোষিত হয়। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগের পর স্পীকার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহের নাম ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেলেও রনিল তা উপভোগ করার যথেষ্ট সময় পাবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ বিক্ষোভকারীরা রনিলকে রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বিবেচনা করে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে জাতিসংঘ। জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী জানায়, সরকারী সম্পত্তি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা পেয়েছেন সেনাসদস্যরা। সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বুধবার রাতে পার্লামেন্টে সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীদের একটি অংশের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানায়। ওই সংঘর্ষের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুটি এ্যাসল্ট রাইফেল কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, সংঘর্ষের সময় সেনাবাহিনীর কয়েক সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ৮৪ জন আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালের দিকে রাজধানী কলম্বো অনেকটাই শান্ত ছিল বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা গোতাবায়ার চূড়ান্ত পদত্যাগের অপেক্ষা করে। তবে শহরজুড়ে কার্ফু জারি রয়েছে। সহিংসতা ঠেকাতে রাস্তায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল। বুধবার শ্রীলঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তিন বাহিনীর কয়েক কমান্ডার ও প্রতিরক্ষা সচিবের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যা যা করণীয়, সবকিছু করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভবন ছেড়ে যেতে বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি তাদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানান। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কট ও গণআন্দোলনের মুখে গত মঙ্গলবার রাতে সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। বৃহস্পতিবার তিনি সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর পৌঁছান। খবরে ইঙ্গিত করা হয়েছে, এরপর তিনি সৌদি আরব অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারেন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গোতাবায়া দেশটিতে তার ব্যক্তিগত সফরে রয়েছেন। কোন ধরনের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সিঙ্গাপুর হয়ে সৌদি আরবের জেদ্দায় যাবেন গোতাবায়া। তবে এ খবরকে অস্বীকার করেছে সৌদি আরব। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে দেশত্যাগ না করার বিষয়ে আদালতে মুচলেকা দিয়েছেন। মাহিন্দা ও বাসিল তাদের আইনজীবীদের মাধ্যমে দেশটির সুপ্রীমকোর্টে মুচলেকা দেন। তারা অঙ্গীকার করেন, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আবেদনের শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তারা দেশ ছাড়বেন না। আজ শুক্রবার শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি জয়ন্ত জয়সুরিয়ার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আবেদনটির ওপর শুনানি হতে পারে। শ্রীলঙ্কার গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা। তিনি গত মে মাস পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গণবিক্ষোভের মুখে তিনিও পদত্যাগ করেন। গোতাবায়ার ছোট ভাই বাসিল। তিনি দেশটির অর্থমন্ত্রী ছিলেন। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কট ও গণআন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার রাতে একটি সামরিক বিমানে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়ে যান গোতাবায়া। এই যাত্রায় তার সঙ্গী হন স্ত্রী ও দুই নিরাপত্তারক্ষী। শ্রীলঙ্কাজুড়ে চলমান সহিসংতা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। এক টুইটবার্তায় তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সংঘর্ষের মূল কারণ এবং আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সমাধান করা। সঙ্কট উত্তরণে দেশটির সব দলের নেতাদের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সমঝোতার মনোভাব গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। বুধবারের আন্দোলনে একজন নিহত ও ৮৪ জন আহত হন। রাজধানী কলম্বো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দিনভর সংঘর্ষ হয়। এর আগে দুই দফা পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ৭৩ বছর বয়সী গোতাবায়া। নিত্যপণ্য, জ্বালানি ও শিশু খাদ্যর মারাত্মক সঙ্কটের কারণে শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাস ধরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলছে। শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনতা মনে করছে এসব পরিস্থিতির জন্য রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতি ও ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী। গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করার পর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। বুধবার পার্লামেন্টের স্পীকার এই ঘোষণা দেন। এরপর চলমান বিক্ষোভ আরও তুঙ্গে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে কলম্বোর প্রধানমন্ত্রী দফতরের প্রধান ফটকের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই দফতর ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী। ঘটনাস্থলে থাকা বিবিসির সাংবাদিক টেসা ওং জানান, পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে যান। তারা কার্যালয়ের ফটক ভেঙ্গে ফেলেন। পরে তারা কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলে নেয়া বিক্ষোভকারীরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ও চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। তারা সেখানে সেলফি তোলেন। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরে ঢোল বাজিয়ে, চিৎকার করে স্লোগান দেন। তারা স্লোগানে বলেন, ‘রনিল পাগল’, ‘গোতাবায়া পাগল।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ার আগে ফটকের বাইরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়া ঠেকাতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। তারা জলকামানও ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে পড়ার আগে শ্রীলঙ্কাজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে একটি সর্বদলীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনে রাজী হয়েছে। মঙ্গলবার পদত্যাগে রাজি হন গোতাবায়া। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ভবন দখলে নেয়ার পর উপায়ান্তর না দেখে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। বুধবারই তার পদত্যাগের কথা ছিল। মঙ্গলবার আকাশ ও নৌপথে পালাতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগের ঘোষণা আসে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর মঙ্গলবার জানায়, প্রেসিডেন্টের সরকারী বাসভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবন দখল করে থাকা বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা দিয়েছে সরকারের এ দুই শীর্ষ ব্যক্তির পদত্যাগের ঘোষণা বাস্তবায়ন না দেখে তারা রাজপথ ছাড়তে রাজি নন। শনিবার দিনভর সহিংস বিক্ষোভের পর হাজারও জনতা প্রেসিডেন্টের বাড়ি দখল করে নেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। গোতাবায়ার পদত্যাগের ঘোষণার পর লঙ্কান পার্লামেন্ট আগামী ২০ জুলাই প্রাথমিকভাবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছে। শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টকে তার পদত্যাগপত্র স্পীকারের কাছে জমা দিতে হয়। গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে প্রথমে বিমানবন্দরে যান। কিন্তু দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তাদের বাধায় তিনি ব্যর্থ হন। শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের উপায় খুঁজছে ভারত ॥ শ্রীলঙ্কার প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ‘দেশটির পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কলম্বোকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে এমন উপায়গুলোতে মনোনিবেশ করছে দিল্লি। কেরলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জয়শঙ্কর বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি খুবই সংবেদনশীল এবং জটিল। শ্রীলঙ্কার জনগণকে সমর্থন করতে আমরা প্রতিশ্রুত। কারণ তারা আমাদের প্রতিবেশী। এ কঠিন মুহূর্তে আমরা তাদের সাহায্য করতে চাই। বন্ধুত্বের অনুভূতির কারণে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
অবশেষে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলেন
0
Share.