গাজী মোঃ জামিল: আজ ১৯ নভেম্বর সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্ঠা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপির ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত কারনে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর, তিনি বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তর পৃর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্ঠা এবং প্রশাসনিক চেয়ারম্যান, ৫ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্ঠা মন্ডলীর অন্যতম সদস্য। মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯২৪ সালের ১ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার দেবপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দেওয়ান হামিদ গাজী। হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর সাথী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ তাজ উদ্দীন কুরেশী তাদের পূর্ব পুরুষ। দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে এরপর মৌলভীবাজার জুনিয়র মাদ্রাসা এবং সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। পরে মাদ্রাসা কারিকুলাম ত্যাগ করে সিলেট রসময় মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ভর্তি হন, এরপর রসময় হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা, ১৯৪৭ সালে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৯ সালে সিলেট মদন মোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ফরিদ গাজী ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪২ সালে ‘কুইট ইন্ডিয়া’, ভারত ছাড়া আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের অঙ্গ সংগঠন আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন, ছাত্র ফেডারেশনের আসাম প্রাদেশিক শাখার সহ-সম্পাদক এবং সিলেট এম.সি কলেজ শাখার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৪৫ সালে আসামে অহমীয়দের ‘বাঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের প্রতিবাদে আন্দোলন এবং লাইন প্রথা বিলোপ আন্দোলনের একজন অগ্রণী কর্মী ছিলেন ফরিদ গাজী। এ সব আন্দোলনে অংশ গ্রহণের জন্য বহুবার তাঁকে পুলিশী নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ১৯৪৭ সালে সিলেটের গণভোটে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে তিনি সিলেটে আন্দোলন সংগঠনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করার লক্ষ্যে সূচিত শান্তি আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ফরিদ গাজী প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশায় আকৃষ্ট হন। ১৯৫০ সালে কিছুকাল তিনি সিলেট রসময় মেমোরিয়াল হাইস্কুল ও সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী (বর্তমানে দৈনিক) পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুগপৎ তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক Eastern Herald (বর্তমানে অবলুপ্ত) সম্পাদনার দায়িত্ব লাভ করেন। ফরিদ গাজী ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যুগভেরী এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঊধংঃবৎহ ঐবৎধষফ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং দলের সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি সিলেট জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। ফরিদ গাজী ১৯৬৪ সালে সিলেটের তোপখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের দায়ে ১৯৬৭ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১১ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুৃব বিরোধী গণআন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালে সিলেট সদর আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনকালে ফরিদ গাজী সিলেটে আন্দোলন সংগঠিত করেন। ফরিদ গাজী মুক্তিযুদ্ধে তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এবং দীর্ঘদিন উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার পাশাপাশি তিনি শরণার্থীদের তত্ত্বাবধানেও নিয়োজিত ছিলেন। ফরিদ গাজী মুক্তিযোদ্ধের পরবর্তীতে সর্বপ্রথম সিলেট বিভাগে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর এবং পরে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ফরিদ গাজী ছিলেন সংস্কৃতিমনা এবং শিক্ষার উদার পৃষ্ঠপোষক। সিলেট অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি সুদীর্ঘকাল সিলেটের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতি ছিলেন। উদার হূদয়ের মানুষ ফরিদ গাজী অত্যন্ত সাদাসিদা জীবনযাপন করতেন। নিরহঙ্কার ও সজ্জন এই মানুষটি দলমত নির্বিশেষে ছিলেন সকল শ্রেণির লোকের শ্রদ্ধাভাজন। দেওয়ান ফরিদ গাজী ২০১০ সালের ১৯ নম্বেভর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজী মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়ান ফরিদ গাজীর পরিবারের উদ্যোগে আজ বিভিন্ন কর্মসৃচীর আয়োজন করা হয়েছিল। কর্মসৃচীর মধ্যে ছিল, কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, বাংলাদেশ সময় বাদ আছর হযরত শাহজালাল (রহ) দরগাহ মসজিদ প্রাঙ্গনে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।