শুক্রবার, ডিসেম্বর ২৭

ইরাকে অপহরণ-নির্যাতনের শিকার ছেলে, বাংলাদেশে বাবা-মায়ের আহাজারি

0

ঢাকা অফিস:  রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা বাদল মিয়া ও তার স্ত্রী ইরাক প্রবাসী ছেলেকে ফিরে পেতে আহাজারি করে চলছেন। ২২ বছর বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহ হক রাব্বিকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে অপরহণকারীরা। কেবল তাই নয়, আশঙ্কার কথা হলো- এখন ছেলেটির কোনো সন্ধানই পাচ্ছেন না বাবা-মা। যদিও প্রবাসে থাকা ছেলেটির সন্ধান পেতে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও দূতাবাস সংশ্লিষ্টরা। ইরাকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।এই অপহরণকাণ্ডে সম্পৃক্ত এক নারীসহ ২ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃত দুইজন আদালতে এই অপহরণে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

যেভাবে অপহরণের তথ্য পেলেন বাবা, দিলেন মুক্তিপণ

সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপ ইমোতে গত ৩ আগস্ট একটি ভিডিও ক্লিপ আসে। সেটি চালু করতেই দেখেন, ইরাক প্রবাসী ছেলে আব্দুল্লাহ হক রাব্বিকে (২২) শিকল দিয়ে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে। বারবার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন তিনি। এরপর ছেলের মুঠোফোনের ইমো থেকে কল করে বাদল মিয়াকে বলা হয়, ‘১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে আব্দুল্লাহকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হবে।’দাবিকৃত ১০ লাখ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই জানালে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় অপহরণকারীরা। একপর্যায়ে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে আব্দুল্লাহকে ছাড়তে রাজি হয় তারা। এরপর দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে দ্রুত টাকা জমা দিতে বলা হয় বাদল মিয়াকে। ছেলেকে বাঁচাতে উচ্চহারে সুদে ঋণ নিয়ে ৫ আগস্ট পাঁচ লাখ টাকা পাঠান ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। টাকা পাঠালেও ২৫ দিন ধরে ছেলের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না বাদল মিয়া।

হাতিরঝিল থানায় মামলা

মুক্তিপণ দিয়েও ছেলের সন্ধান না পেয়ে বাদল মিয়া গত ২৪ আগস্ট হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে নেমে ২৫ আগস্ট ফরিদপুরের সদরপুর থেকে রনি মুনসি এবং ঢাকা থেকে শাহনাজ বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শাহনাজ বেগম পেশায় রাজারবাগ প্রশান্তি হাসপাতালের আয়া। তার অ্যাকাউন্টেই ৫ লাখ টাকা জমা দেন আব্দুল্লাহর বাবা বাদল মিয়া। গ্রেপ্তারের পরদিন ২৬ আগস্ট দু’জনেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

ইরাকে অবস্থানকারী ৪ অপহরণকারী কার বাড়ি কোথায়?

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার দুজন ছাড়া এই চক্রের আরও ৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্য ৪ জন ইরাকে অবস্থান করছেন। তারা হলেন- ফরিদপুর সদরপুর থানার জহিরুল ইসলাম, হাবিব ফকির, জিয়াউর রহমান ও সুনামগঞ্জের ছাতক থানার শিহাব উদ্দিন। বাংলাদেশে অবস্থানরত চক্রটির অপর দুই সদস্য আতিয়া সুলতানা নিপা ও মুরাদ ফকির পলাতক। নিপা এই চক্রের সদস্য ইরাক প্রবাসী জহিরুল ইসলামের স্ত্রী। মুরাদ ফকির ১ মাস আগে ইরাক থেকে দেশে ফেরেন। তিনি জহিরুল ইসলামের চাচাতো ভাই।

পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি’র হস্তক্ষেপ

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ইরাকে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জিম্মি করে নির্মম নির্যাতনকারী একটি চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে। চক্রের সদস্যরা বৈধ নাকি অবৈধভাবে ইরাকে গেছেন এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি (ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো) এবং সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, বাদল মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া টাকা চক্রের সদস্যরা ভাগ-বাটোয়ারা করে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন।

হাসপাতালের আয়া শাহনাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন

এসব নম্বর ও অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে তদন্ত চলছে। গ্রেপ্তার হাসপাতালের আয়া শাহনাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসেই অস্বাভাবিক অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এই চক্রটি আরও কয়েকজনকে অপহরণ করে এভাবে মুক্তিপণ আদায় করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে মুক্তিপণ পাঠানো হয়

আব্দুল্লাহর বাবা বাদল মিয়া প্রায় ২৫ বছর ধরে পরিবার নিয়ে হাতিরঝিল থানাধীন তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় বসবাস করেন। ৩ সন্তানের জন্ম এই এলাকাতেই। সংসারের অভাব ঘুচাতে চার বছর আগে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে ইরাকে যান আব্দুল্লাহ। কুর্দিস্তানে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করে নিয়মিত দেশে টাকাও পাঠাতেন তিনি। তবে করোনা মহামারিতে রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেলে অর্থ সংকটে পড়েন তিনি। তবে ঈদুল আজহার আগে রেস্তোরাঁ চালু হওয়ার পর আবারও কাজে ফেরেন আব্দুল্লাহ। বাদল মিয়া বলেন, ছেলের নির্যাতনের ভিডিও দেখার পর তারা দিশেহারা হয়ে পড়ি। ঘরে ৫০ হাজার টাকা ছিল। বাকি সাড়ে ৪ লাখ টাকা উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছি। প্রতি মাসে সুদই দিতে হবে ২৫ হাজার টাকা করে। এভাবে মুক্তিপণ দিয়েও লাভ হয়নি, ছেলে বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’

Share.