লাইফস্টাইল ডেস্ক: দেশে সেমাই ছাড়া ঈদ উদযাপন কল্পনা করা যায় না। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, ঈদের সাথে সেমাইয়ের এই যোগসূত্র কিন্তু খুব পুরনো নয়। তবে ইতিহাস বলে সেমাইয়ের প্রচল নিয়ে আছে ভিন্ন রকম মত।ঈদুল ফিতরের সঙ্গে সেমাইয়ের সম্পর্কটা কীভাবে তৈরি হলো তার হদিস পাওয়াটাও একটু কঠিন। বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গ্রন্থে যেটুকু পাওয়া যায় তার মধ্যে সেমাইয়ের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। তবে ফিরনির কথা আছে। নবাব আলিবর্দী খাঁর খাদ্য তালিকায় খিচুড়ির উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল। সেমাইয়ের বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায় না মোগল রসুইঘরেও। সুতরাং সেমাই মোগলাই খাবারের মধ্যে পড়ে না।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও বেশ কিছু খাবারের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সেমাইয়ের কথা কোথাও নেই। হিন্দু কবিদের রচনাতে তো নেই। মুসলমান কবির রচনাতেও নেই। সেমাইয়ের দেখা পাওয়া যায় না মোগলদের রন্ধনশালাতেও। অর্থাৎ সেমাই মোগলাই খানার মধ্যে পড়ে না। অথচ সম্রাট বাবর এসেছিলেন যে আফগানিস্তান থেকে সেই আফগানিস্তানে এখনো সেমাই চলে তবে ভিন্ন নামে। আগেও নিশ্চয় চলতো। সেখানে সেমাইকে বলে ‘সেমিরা’।ভারতের অনেক অঞ্চলে অবশ্য সেমাই রান্নার প্রকরণ দুই রকম। এক হলো নামকিন সেমিয়া অর্থাৎ তা নোনতা স্বাদের। অন্যটা হলো সেভিয়া ক্ষির বা দুধ সেমাই। নামকিন সেমিয়া নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। কথা বলতে গেলে নুডল্স, স্প্যাগেটি, চাওমিন ইত্যাদি খাদ্য চলে আসবে। আমার কথার বিষয় খাওয়া শেষে মুখ মিষ্টি করার মিষ্টান্ন নিয়ে। মিষ্টান্ন হিসেবে সেমাইয়ের ব্যাপারটা কিন্তু বহুজাতিক। মিষ্টি স্বাদ ও চেহারার সেমাই পাওয়া যাবে গ্রিসে নাম কাতাইফি। বাংলাদেশে ঘি দিয়ে ভেজে যে দমের সেমাই তৈরি হয়, প্রায় সেরকমই সেমাইয়ের দেখা পাওয়া যাবে আফ্রিকার সোমালিয়াতে নাম কাদ্রিয়াদ।প্রচলিত বাংলা অভিধানে সেমাই শব্দটাকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও দেশি। তবে ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন গ্রিক শব্দ সেমিদালিস থেকে বাংলা সেমাই শব্দের উৎপত্তি। আমরা যে সেমাই খাই তার রন্ধন-প্রণালী ও স্বাদ গ্রিস না অন্য কোনো দেশের তার সুলুকসন্ধান কেউ দিতে পারেননি। তাই অনেক পণ্ডিত আবার সেমাই শব্দের উৎস সন্ধানে অন্য পথ ধরেছেন।জানার আগ্রহ নিয়ে শব্দের পথ ধরে ইতিহাসের দিকে এগোনো যায় বহু পথ। আর শব্দের অর্থ দিয়ে খোলা যায় অতীতের অনেক ইতিহাসের দরজা। এদিকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেমাই শব্দের বুৎপত্তি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, সেমাই শব্দের গায়ে গ্রিসের গন্ধ থাকলেও সেমাই দ্রব্যটা আসলে ভারতীয়। ভারতের অনেক রাজ্যেই সেমাই নানাভাবে খাওয়া হয়। এছাড়া উপমহাদেশের মুসলমান-মাত্রই ঈদের দিনে সেমাই খায়। অন্যদিকে পাকিস্তানেও সেমাই ছাড়া ঈদ কল্পনা করা যায় না।বাংলাদেশে এখন প্যাকেটজাত সেমাইয়ের ছড়াছড়ি। মেশিনে বানানো এই সেমাই বাহারি সব প্যাকেটে পাওয়া যায়। মজার কথা হলো, এই যে প্যাকেটজাত কিংবা বোতলজাত ইত্যাদি শব্দের যে (জাত) তার অর্থ হলো রক্ষিত, সঞ্চিত ইত্যাদি। প্যাকেটজাত মানে প্যাকেটে রক্ষিত। শব্দটা আরবি থেকে আসা। শব্দের জাত চেনা সত্যিই মুশকিল। কারণ এই জাত শব্দটার আবার বাংলা অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা।৮০ থেকে ৯৫ বছর আগে সুদূর মফঃস্বল বা গ্রামে প্যাকেটজাত রেডিমডে সেমাই পাওয়া যেতো না। শহরে পাওয়া যেতো কিনা তা জানা নেই। ঈদের বেশ ক’দিন আগে থেকেই গ্রামের নারীদের হাতে তখন তৈরি হতো আদি অকৃত্রিম ঈদের সেমাই। বাড়িতে বাড়িতে সেমাই তৈরির ধুম পড়ে যেতো। মা-খালা-চাচি-ফুপিরা মাটির কলসি উপুড় করে হাতের অপূর্ব সৃজন ক্ষমতা ও দক্ষতায় আটা-ময়দার লেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নতুন কেনা কুলোয় নামাতেন নরম সুতো। ক্রমাগত সুতো নেমে তৈরি হতো সেমাইয়ের স্তূপ। আর এভাবেই তৈরি হতো হাতে বানানো সেমাই। তবে বর্তমানে সেমাই দুই প্রকারের। খিল সেমাই বা তার সেমাই। আরেকটা হলো লাচ্চা বা লাচ্চি সেমাই।
ঈদে সেমাইয়ের প্রচলন কিভাবে শুরু হলো
0
Share.