ঢাকা: গত দুই বছর ধরেই বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেশে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিচ্ছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় এই সংকট দেখা দেয়। এর ফলে এ সময়ে লাগামহীনভাবে দাম বেড়ে যায় বাঙালির রসুইঘরের অপরিহার্য এ উপকরণটির। প্রথাগত রান্নার রেসিপি থেকে এটিকে বাদ দেয়ারও জো নেই। এমন সংকটে দারুন আশার কথা শোনালো বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র। হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, গরম মসলার মতো এখন থেকে মিলবে ‘পেঁয়াজ গুঁড়া’। প্যাকেটজাত এই ‘পেঁয়াজ গুঁড়া’ কাঁচা পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। দেশীয় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ছোট পরিসরেও উদ্যোক্তারা পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদন করতে পারবেন, সংরক্ষণও করতে পারবেন সহজেই। উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সহজে ‘গুঁড়া পেঁয়াজের’ উৎপাদন প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দিতে পারলে আমদানি ছাড়াই পেঁয়াজের সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র এরই মধ্যে দেশীয় পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলকভাবে পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদন শুরু করেছে। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রে ড. মাসুদ আলমের তত্ত্বাবধানে গবেষণাগরে পেঁয়াজের গুঁড়া উৎপাদন চলছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে গবেষণারত এই বিজ্ঞানী জানান, অনেক দেশেই পেঁয়াজের গুঁড়ার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই। আবার অন্য দেশগুলোতে পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদনে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, সেটি ব্যয়বহুলও বটে। এ অবস্থায় সহজে পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদনের দেশীয় পদ্ধতি উদ্ভাবন নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদনের পদ্ধতি ব্যাখা করে ড. মাসুদ বলেন, এই পদ্ধতিটি খুব সাধারণ। প্রথমে খোসা ছাড়িয়ে পেঁয়াজ স্লাইস করে ভাপ দিতে হবে। পরে তা শুকিয়ে নিয়ে সোডিয়াম মেটাবাইসালফেট দ্রবণে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর আবার তা শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর সাধারণ ব্লেন্ডিং মেশিনেই এটি গুঁড়া করা যাবে। মাসুদ আলম আরও বলেন, আমরা একবছরের কথা বললেও এই পেঁয়াজ গুঁড়া দুই বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়া পদ্ধতিটি জটিল না হওয়ায় ছোট উদ্যোক্তাদের জন্যও ঘরে বসেই এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব। ফলে এই প্রযুক্তিটি নিশ্চিতভাবেই পেঁয়াজ সংকটের সমাধান বয়ে আনার জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি প্রযুক্তি। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আমাদের দেশে বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন গড়ে ২৫ লাখ মেট্রিক টনের আশপাশে। সনাতনী পদ্ধতি অনুসরণ করায় উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যায়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ ছয় থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়। অথচ দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা মূল উৎপাদন, অর্থাৎ ২৫ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। অর্থাৎ গড়ে প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে দেশে। এ কারণেই এই পণ্যের বাজারে আমদানি নির্ভরতা অনস্বীকার্য। ফলে আমদানি ব্যাহত হলেই সংকট তৈরি হয় পেঁয়াজের বাজারে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পোস্ট হারভেস্ট) ড. মো. মাসুদ আলম ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্যানতত্ত্ব) কৃষিবিদ নুর আলম চৌধুরী জানান, পেঁয়াজের ফলন বাড়াতে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় জাতের পেঁয়াজের হেক্টর প্রতি উৎপাদন যেখানে ১০ থেকে ১১ টন, সেখানে তাদের উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ পেঁয়াজের উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ২৩ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমনকি বারি-২, ৩, ৪ ও ৬ জাতের পেঁয়াজের ফলনও সাধারণ জাতের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এসব পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল সর্বোচ্চ তিন মাস। ফলে এসব জাতের পেঁয়াজের আবাদ প্রসার পায়নি। এ কারণেই তারা পেঁয়াজের উৎপাদন বা ফলনের পরিবর্তে সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছেন। আর তাতেই উদ্ভাবিত হয়েছে পেঁয়াজ গুঁড়া।গবেষক মাসুদ আলম বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত পেঁয়াজ গুঁড়া পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সংরক্ষণজনিত সমস্যা থাকবে না বললেই চলে। কারণ পেঁয়াজের গুঁড়া অনায়াসে একবছর প্যাকেটজাত করে সংরক্ষণ করা যায়। এতে দুইভাবে সুবিধা পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, দেশে সাধারণভাবে পেঁয়াজের যে ফলন হয়, তার বড় অংশ এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে এই ফলনের অপচয় রোধ করা যায়। দ্বিতীয়ত, পেঁয়াজের উচ্চ ফলনশীল জাত থাকলেও কেবল সংরক্ষণকাল কম হওয়ায় সেগুলোর আবাদ নেই বললেই চলে। গুঁড়া করে সংরক্ষণ করতে পারলে ওই পেঁয়াজের আবাদের প্রসার ঘটাতে কৃষকদের উৎসাহ দেয়া যাবে।