বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬

ওজন বাড়াতে যা করবেন

0

স্বাস্থ্য ডেস্ক: ওজন কমানোর দৌড়ে এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বিশেষ করে নারীরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। এ তালিকায় সবচেয়ে বেশি নাম মডেল ও অভিনেত্রীদের। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে একটা অংশ মেদ ভুড়ি কমাতে কসরত করে গেলেও বড় একটি অংশ জিমে ছুটছেন মাসল বাড়াতে। কেউ আবার অনেক বেশি খাওয়া-দাওয়া করেও বাড়াতে পারছেন না ওজন। রোগা-পাতলা শরীরের কারণে কোন পোশাক পরেই স্বস্তি বোধ করেন না। রোগা বলে অনেকের কাছে কটু কথাও শুনতে হয়। উচ্চতা ও বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত ওজন যেমন নানা রোগের কারণ, তেমনি কম ওজনও ক্ষতিকর।  বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ওজন স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ কম হলে তাকে কম ওজনের অধিকারী বলা হয়। দেহের ওজন বেশি না কম তা জানা যায় শরীরের ঘনত্বসূচক বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই দিয়ে। বিএমআই = ওজন (কিলোগ্রাম)/উচ্চতা (মিটার)। বডি ম্যাস ইনডেক্স ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

যেমন: ভাষা হতে হবে ইংরেজি, উচ্চতা যদি সে.মি. ব্যবহার করেন তাহলে ওজন অবশ্যই কেজি হবে, আবার উচ্চতা যদি ইঞ্চি ব্যবহার করেন তাহলে ওজন অবশ্যই পাউণ্ড হবে, আপনাদের সুবিধার্থে নিচে কয়েকটি কনভার্শন দেখানো হলো-
১ ইঞ্চি = ২.৫৪ সে. মি., ১০০ সে. মি.=১ মি., ১ ফুট = ০.৩০৪৮ মি. = ৩০. সে. মি.। ১ কেজি = ২.২ পাউণ্ড।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ১৮.৫ এর কম হলে কম ওজন, ১৮.৫ থেকে ২৪.৯৯ হলে স্বাভাবিক এবং ২৫ এর বেশি হলে অতিরিক্ত ওজন ধরা হয়। সাধারণভাবে বিএমআই ১৮.৫-এর নিচে হলে ওজন বাড়ানো উচিত। তাই ওজন কম থাকলে সেটি বাড়াতে পারেন কিছু নিয়ম মেনে। ওজন বাড়াতে হলে আপনাকে নিয়ম মেনে কিছু ব্যায়াম যেমন করতে হবে, তেমনি খাদ্য তালিকায়ও আনতে হবে পরিবর্তন।

ওজন বাড়াতে ব্যায়াম

কিছু ব্যায়াম আছে যা ওজন কমিয়ে শরীরকে ঝরঝরে রাখতে সাহায্য করে। আবার কিছু ব্যায়াম বৃদ্ধি করে মাসল। বাড়ায় ওজন। তাই আপনাকে জানতে হবে কোন আপনার জন্য উপযুক্ত। এ ব্যাপারে ভালো কোন জিম ইনস্ট্রাকটরের পরামর্শ নিতে পারেন। তিনি আপনার বয়স, ওজন সবকিছু পরীক্ষা করে ব্যায়াম নির্ধারণ করে দেবেন। একইসঙ্গে দেখিয়ে দেবেন কীভাবে ব্যায়ামগুলো করলে ভালো ফল পাবেন। তারপরও কিছু ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হলো যা আপনার ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে।

ওজন বাড়াতে হলে জিমে গিয়ে হার্ড ব্যায়াম করতে হবে। সাধারণভাবে জিমে মানুষ এমন ওয়েট নেয়, যা দিয়ে প্রতি সেটে ১০ থেকে ১৫ বার করতে পারে। কিন্তু ওজন বাড়াতে হলে মেশিন ব্যবহার না করে ফ্রি ওয়েট নিয়ে ব্যায়াম করতে হবে। আর এমন সব ব্যায়াম করতে হবে সেসব ব্যায়ামে একই সঙ্গে একাধিক পেশিতে চাপ পড়ে। এগুলোকে কোর বা কম্পাউন্ড ব্যায়াম বলে। যেমন-

১. বেঞ্চপ্রেস : বুক, কাঁধ, বাহু। ২. ওভারহেড প্রেস : কাঁধ, বাহু । ৩. পুলআপ/রো : পিঠ, বাহু। ৪. স্কোয়াট : পা, পিঠের নিম্নভাগ। ৫. ডেডলিফট : পা, পিঠ, কাঁধ। ৬. বার ডিপ : কাঁধ, বুক, বাহু।

শুরুতে প্রতিদিন ব্যায়াম করবেন না। সপ্তাহে তিন দিন (এক দিন পর পর) ব্যায়াম করবেন। প্রতিটা সেশন ৬০ মিনিট থেকে ৭৫ মিনিটের মধ্যে রাখবেন। কারণ শরীর ক্লান্ত হওয়ার পর ব্যায়াম করলে পেশি ক্ষয় হবে। জিম শুরুর দুই ঘণ্টা আগে খাবেন এবং শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই আবার খাবেন। প্রথম তিন সপ্তাহে যত পারেন (কমপক্ষে ২৫০০ ক্যালরি) খাবেন। এ সময় মেপে খেতে হবে না। তবে প্রোটিনের পরিমাণ অবশ্যই বেশি থাকতে হবে। অর্থাৎ, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বেশি করে খেতে হবে। প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর কিছু না কিছু খাবেন এবং প্রচুর পানি খাবেন। যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেবেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ঘুমাবেন।

কখন কোন ব্যায়াম করবেন

প্রথম দুই সপ্তাহ

প্রথম দিন : বুক, পিঠ ও পেটের ব্যায়াম করুন।
দ্বিতীয় দিন : পা ও পেটের ব্যায়াম করুন
তৃতীয় দিন : কাঁধ, বাহু ও পেটের ব্যায়াম করুন।

এই দুই সপ্তাহে আপনার কমপক্ষে এক থেকে দুই কেজি ওজন বাড়বে। কিন্তু এরপর আর যতই খান, আপনার শরীর নিতে পারবে না। কেননা আপনার এনাবলিক হরমোন নরমাল পর্যায়ে চলে আসবে। তখন শরীরের বৃদ্ধিও কমে আসবে।

তৃতীয় সপ্তাহে খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে। ১৩০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরির মধ্যে খেতে হবে। খাবার খুব সাদামাটা হতে হবে। ফ্যাট আর কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে কম খাবেন। ফল ও সবজি বেশি খাবেন। খুব হালকা ওয়েট নিয়ে ১০ থেকে ১৫ রেপস করে দেবেন। শরীরের ওপর খুব চাপ দেবেন না। কেননা এই সপ্তাহে আপনি খাচ্ছেন কম। এই সপ্তাহটা হবে শরীরের মেইনটেন্যান্স পর্ব মাত্র। এ পর্বে শরীর থেকে কিছুটা পানি বেরিয়ে যাবে, তাই একটু হালকা হয়ে যাবেন। একটু ওজন কমে যাবে। হতাশার কিছু নেই। পরের দুই সপ্তাহে বেশি খাবার ও হার্ড ব্যায়ামের ফলে শরীর আবার ফুলতে শুরু করবে। পেটে খাবার পড়ামাত্রই শরীর স্পঞ্জের মতো চুষে নেবে। ক্ষুধাও লাগবে প্রচুর। অর্থাৎ, আপনার শরীরের খাবারের চাহিদা বেড়েছে এবং শরীর খাবার থেকে পুষ্টি সংগ্রহে সক্ষম হচ্ছে।

তৃতীয় সপ্তাহ
প্রথম দিন: বুক, কাঁধ, ট্রাইসেপ, পেট।
দ্বিতীয় দিন: পা, পেট।
তৃতীয় দিন: পিঠ, বাইসেপ, পেট।

৪র্থ ও পঞ্চম সপ্তাহ
এই দুই সপ্তাহে আপনি আবারও হার্ড ব্যায়াম করবেন। খাবেনও বেশি। প্রচুর আমিষ খাবেন। প্রতি তিন ঘণ্টায় ৩০০ ক্যালরির বেশি খাবার খাবেন।

প্রথম দিন : বুক, কাঁধ ও পেটের ব্যায়াম করুন।

দ্বিতীয় দিন : পা ও পেটের ব্যায়াম করুন।

তৃতীয় দিন : পিঠ ও পেটের ব্যায়াম করুন।

এভাবে চালিয়ে গেলে প্রতি তিন সপ্তাহে এক-দুই কেজি করে ওজন বাড়বে। এই পদ্ধতি যত দিন না আপনার ওজন কাঙ্ক্ষিত ওজনের চেয়ে বেশি হয়, তত দিন চালিয়ে যেতে হবে। ধরুন, আপনার ওজন দরকার ৭০ কেজি, তাহলে ৭৫ কেজি পর্যন্ত বাড়াবেন। তারপর অন্য পদ্ধতির ব্যায়াম করে বাকি পাঁচ কেজি, ওজন কমিয়ে ফেলবেন।

খেয়াল রাখবেন

* ব্যায়াম সময় হবে বড়জোর এক ঘণ্টা। কেননা পেশি বাড়াতে যে হরমোনের দরকার হয়, সেটা এক ঘণ্টা পরে কমে যেতে শুরু করে। তাই এক ঘণ্টার পরও যদি ব্যায়াম করেন, তাহলে পেশি ক্ষয় হতে শুরু করবে।

* ব্যায়াম করার সময় একটা সেট শেষ করে আরেকটা সেট শুরু করার মধ্যে যত কম বিশ্রাম নিতে পারবেন, তত ভালো। বড়জোর ৯০ সেকেন্ড বিশ্রাম নিন। তারপর আবার পরের সেটের ব্যায়াম শুরু করে দিন। বেশি বিশ্রাম নিলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে।

* এক দিন পর পর ব্যায়াম করা ভালো। মনে রাখবেন ব্যায়াম শুধু পেশিকে নাড়িয়ে দেয়, রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়। পেশি বাড়ে যখন খাওয়া ও ঘুম বা বিশ্রাম নেবেন তখন। এ ছাড়া পেশি যথেষ্ট বিশ্রাম পেলে পরেরবার জিমে গিয়ে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারবেন। না হলে ক্লান্তি লাগবে, ব্যায়াম করার আগ্রহ কমে যাবে।

* প্রতি সেট ব্যায়ামে ছয় থেকে ১৫ বারের বেশি যাবেন না। হালকা ওয়েট নিয়ে বেশিবার করলে শরীর নরম গঠনের হয়ে যাবে। পেশি বাড়াতে চাইলে বেশি ওজন নিয়ে যত কমবার করতে পারেন, তত ভালো।

* দিনের পর দিন একই রুটিনে ব্যায়াম না করাই ভালো। মাঝেমধ্যে রুটিন পরিবর্তন করতে পারেন। অর্থাৎ, কয়েক সপ্তাহ পরে মাঝের ব্যায়ামটা আগে, প্রথম ব্যায়ামটা পরে-এভাবে ঘুরিয়ে নিতে পারেন। এতে একঘেয়েমি লাগবে না।

* ব্যায়াম করার সময় অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের যেটুকু সামর্থ্য, সেটুকুই সঠিকভাবে করবেন। কখনোই অন্যের শক্তি বা শরীরের সঙ্গে নিজের তুলনা করবেন না। আপনার প্রতিযোগিতা হবে নিজের সঙ্গে, নিজের বর্তমান অবস্থা থেকেও আরো ভালো অবস্থায় যাওয়ার।

* দৌড়ানো, হাঁটা, সাঁতার, সাইকেল চালানো-এ ধরনের বাড়তি কাজ যতটা সম্ভব কম করবেন। কেননা এতে আরো ওজন কমার আশঙ্কা থাকে।

* জিমের মেশিন এড়িয়ে চলবেন। ফ্রি ওয়েট ব্যবহার করবেন।

* রুটিন বানিয়ে ব্যায়ামের নোট রাখবেন। এতে হিসাব থাকবে যে এ সপ্তাহে কত ওজন নিতে পারলেন বা কতবার করতে পারলেন। পরের সপ্তাহে চেষ্টা করবেন সেই একই ব্যায়ামে দুই কেজি বা পাঁচ পাউন্ড ওজন বাড়াতে। যেমন ধরুন এই সপ্তাহে ৫০ কেজি দিয়ে আটবার বেঞ্চপ্রেস দিতে পারলেন। পরের সপ্তাহে টার্গেট থাকবে ৫২ কেজি দিয়ে আটবার দেওয়ার। এতে বুঝতে পারবেন আপনার ব্যায়ামের এবং শক্তির কতটা উন্নতি হচ্ছে।

* দুই সপ্তাহ পর পর শরীরের ওজন এবং ফিতা দিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশের মাপ নেবেন। এটাও লিখে রাখবেন। টার্গেট রাখবেন প্রতি দুই সপ্তাহে দুই কেজি করে ওজন বাড়াতে।

ওজন বাড়াতে যা খাবেন

১. লাল মাংসে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকলেও এটি ওজন বাড়াতে সক্ষম৷ লাল মাংসে রয়েছে প্রোটিন, আয়রন ও ফ্যাট। ওজন বাড়াতে চাইলে অলিভ অয়েল দিয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না করা মাংস খেতে পারেন নিয়মিত।
২. ওজন বাড়াতে চাইলে প্রতিদিন পিনাট বাটার খান। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাট রয়েছে। এছাড়া ম্যাগনেসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন বি ও ভিটামিন ই রয়েছে এই বাটারে। প্রতিদিন সকালে ব্রেডের সঙ্গে খেতে পারেন পিনাট বাটার।
৩. প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এক গ্লাস দুধ রাখুন। দুধ যেন ফ্যাট ছাড়া না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন।
৪. আম ও আনারসের মতো প্রাকৃতিক চিনিযুক্ত ফল খান নিয়মিত।
৫. ওজন বাড়াতে চাইলে প্রতিদিন সকালে ময়দার রুটি রাখুন। ফাইবার ও এমন কিছু মিনারেল রয়েছে ময়দার রুটিতে যা অন্য রুটিতে নেই।
৬. মাখন খেতে পারেন প্রতিদিন। রান্নায় তেলের বদলে মাখন ব্যবহার করা যেতে পারে। উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন মাখন ওজন বাড়াতে সাহায্য করবে। তবে অতিরিক্ত মাখন খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
৭. নিয়মিত ঘি খেলে ওজন বাড়ে। চর্বি ছাড়াও ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে ঘিতে।
৮. স্ন্যাকস হিসেবে বাদাম খেতে পারেন প্রতিদিন। বাদামে রয়েছে চর্বিজাতীয় উপাদান ও বিভিন্ন পুষ্টিগুণ যা ওজন বাড়ায়।
৯. আলু খান প্রতিদিন। প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায় আলু থেকে যা ওজন দ্রুত বাড়াতে সাহায্য করে।
১০. পটাসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট ও নানা রকম প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয় কলা। ওজন বাড়াতে চাইলে তাই প্রতিদিন কলা খাওয়ার বিকল্প নেই।
১১. দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পনির রাখুন। প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটজাতীয় উপাদান পাওয়া যায় পনির থেকে যা দ্রুত আপনার ওজন বাড়াবে।

Share.