জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেলো নগদ’র বিরুদ্ধে

0

ডেস্ক রিপোর্টঃ  ডিজিটাল জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেল মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ লিমিটেড’ এর বিরুদ্ধে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে হিসাব মিলছে না ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ পরিচালনায় যে প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বসিয়েছে, তাদের পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। নগদে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হলেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর। কর্মকর্তারা বলছেন, নগদে ঘটা অনিয়ম টাকার হিসাবে দেশের সবচেয়ে বড় ‘ডিজিটাল জালিয়াতি’। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, নগদে ফরেনসিক নিরীক্ষা হবে। ফরেনসিক নিরীক্ষা হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত খতিয়ে দেখা, যার মাধ্যমে জালিয়াতি, অনিয়ম ও এর সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে জালিয়াতির কারণে যে আর্থিক দায় তৈরি হয়েছে, তা ডাক অধিদপ্তরের ঘাড়ে পড়ছে। কারণ, মোবাইলে আর্থিক সেবা দিতে যে সাময়িক অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে, সেটি তাদের। ডাক অধিদপ্তরের পক্ষে সেবাটি পরিচালনা করে নগদ লিমিটেড, যা একসময় ছিল থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি লিমিটেড। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম শাহাব উদ্দীন গত রোববার রাতে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে জানান, ‘এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।’

ডিজিটাল যত জালিয়াতি
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিয়োগ পাওয়া প্রশাসক নগদ পরিচালনার পাশাপাশি আর্থিক অনিয়ম খুঁজে বের করা শুরু করেন। এতেই উঠে আসে বড় অঙ্কের ডিজিটাল জালিয়াতির বিষয়টি। নথিপত্রে বলা হয়েছে, ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে ২০১৭ সালে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকে যত টাকা জমা থাকবে, ঠিক তার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করা যাবে। তবে প্রশাসক দল দেখতে পায় যে নগদে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করা হয়েছে। প্রশাসক দলের পক্ষ থেকে ডাক অধিদপ্তরকে আরও জানানো হয়েছে, অনুমোদন ছাড়াই নগদে ৪১টি পরিবেশক হিসাব খোলার মাধ্যমে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিবেশক হিসাবের দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ করা।
জানা গেছে, নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের নেতারা যুক্ত থাকায় তৎকালীন সরকার ভাতা বিতরণের জন্য নগদকে বেছে নিয়েছিল। আর এ সুযোগে সরকারি ভাতার একটা অংশ নিয়ে জালিয়াতি করা হয়। বিশেষ করে হিসাবে টাকা দেওয়ার পর যেসব ভাতাভোগী তিন দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করেননি, তাঁদের টাকা তুলে নেয় নগদ। নথিপত্রে দেখা গেছে, কুমিল্লার পরিবেশক রংপুরের ভাতাভোগীদের অর্থ বিতরণ করেছে। ফলে এ ক্ষেত্রেও জালিয়াতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগদের একজন কর্মকর্তা।
নগদের প্রশাসক দল মনে করে যে অনুমোদন ছাড়াই যেসব পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ছয় কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা ডাক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন নগদের নির্বাহী পরিচালক সাফায়েত আলম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা আবু রায়হান, আর্থিক প্রশাসন ও পরিচালনা বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলাম এবং সলিউশন ডিজাইন বিভাগের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজমুস সাকিব আকিব। তবে নগদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান অদৃশ্য এক শক্তিতে নিজের নাম কাটিয়েছেন এই রিপোর্ট থেকে। বিগত সরকার প্রধান শেখ হাসিনার বেশ ঘনিষ্টজন হিসাবে পরিচিত জনাব মেহেদী হাসান বর্তমানে প্রকাশ্যে গুলশান ক্লাব থেকে চার নম্বর ব্যালটি হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক নগদের এক কর্মকর্তা জানান, ততকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অর্থ লেনদেনেও সক্ষতা ছিলো মেহেদীর। এই সক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নগদ ছাড়াও বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালক পদে থেকে অনিয়ম করেছেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে মেহেদী হাসান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন করে চলেছেন। গত ৫ আগস্টের পর আর অফিসে যাননি তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ; নির্বাহী পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ওরফে এলিট ও মারুফুল ইসলাম ওরফে ঝলক; উপপ্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ সোলায়মান (সোলায়মান সুখন) এবং মানবসম্পদ কর্মকর্তা অনিক বড়ুয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২১ আগস্ট নগদে প্রশাসক বসায়। তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত ব্যক্তিদের অনেকে নগদ লিমিটেডের মালিকানায়ও রয়েছেন।
যোগাযোগ করা হলে নগদের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার সময়ে ৩৪৫ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এটা পরে কমে ৬০ কোটি টাকায় এসেছিল৷ অন্য কোনো অনিয়ম আমার সময়ে হয়নি।’

শুরুতেই বড় গলদ
ডাক অধিদপ্তরের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে ডাক অধিদপ্তর পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সেবা প্রচলনের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। পাশাপাশি এতে ডিজিটাল আর্থিক সেবার কথাও যুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তিতে বলা হয়, পরিবেশন ও অন্যান্য খরচ বাদে গ্রাহক কমিশন থেকে যে আয় থাকবে, তার ৫১ শতাংশ পাবে ডাক বিভাগ ও ৪৯ শতাংশ পাবে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি। এরপর ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ডাক অধিদপ্তর ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। শর্ত মেনে আবেদন না করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। তবে ডাক অধিদপ্তর নিজেদের আইনে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালু করে দেয়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবাটি উদ্বোধন করেন। শর্ত পূরণ না করলেও ২০২০ সালের ১৫ মার্চ নগদকে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দিয়ে ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময় ব্যাংক হিসাব (ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট হিসাব) ডাক বিভাগের নামে খোলার শর্ত দেওয়া হয়। তবে থার্ড ওয়েভ সে পথে যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো তদারক করেনি। এরপরও দফায় দফায় অনুমোদনের মেয়াদ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি নিজেই নাম পরিবর্তন করে নগদ লিমিটেড হয়ে যায়। এককভাবে সরকারি ভাতা বিতরণ, শর্ত ছাড়া হিসাব খোলার সুযোগ ও সহজেই হিসাব খোলার সুবিধার ফলে নগদ হয়ে ওঠে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। সেবাটির গ্রাহক প্রায় ৯ কোটি। দিনে এক হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে নগদে। মোবাইলে আর্থিক সেবার চূড়ান্ত অনুমতি না পেলেও নগদকে প্রথমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পরে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর প্রাথমিক অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

পেছনে কারা
থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির প্রতিষ্ঠা ২০১৬ সালে। তানভীর আহমেদের পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা ও মিজানুর রহমান। নগদের কার্যক্রম শুরুর আগেই অংশীদারদের কেউ কেউ থার্ড ওয়েভের শেয়ার ছেড়ে দেন। এর মধ্যে কাজী মনিরুল কবির শেয়ার ছেড়ে দিলে মালিকানায় যুক্ত হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন দুই সংসদ নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। যোগ দেন রেজওয়ানা নূর, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী। পরে তিনিও মালিকানা ছেড়ে দেন। তবে বর্তমানে নগদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিরেক্টর হিসাবে অনেকটাই আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছেন ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান। ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগের অর্থদাতা হিসাবে তার নামে গাজীপুরের গাছা থানায় দুটি হত্যা মামলা থাকলেও পরবর্তিতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কিছু সংখ্যক অসাদু নেতাদের যোগসাজসে সেই মামলা থেকে নিজের নাম কাটান মেহেদী হাসান। ২০১৮ সাল থেকে নগদকে ডাক বিভাগের সেবা হিসেবে প্রচার করা হলেও সরকারের এ সংস্থা এর মালিকানায় ছিল না, এখনো নেই। নগদ ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, নগদ লিমিটেডে এখন পরিচালক নয়জন, যাঁরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের একজন করে নাগরিক রয়েছেন। অন্য ছয়জন বাংলাদেশি।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, নগদের শেয়ারধারী একটি কোম্পানির মালিকানায় ছিলেন নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। আর নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর আহমেদ, জুনিয়র চেম্বার সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ ও জুনিয়র চেম্বার ঢাকার সাবেক সভাপতি মারুফুল ইসলাম রয়েছেন নগদের শেয়ারধারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়। এর মধ্যে নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ফলে নগদ পরিচিত হয়ে উঠেছিল তৎকালীন সরকারদলীয় নেতাদের একটি ক্লাব হিসেবে।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, নগদের পেছনে সব সময় বড় হাত ছিল। এ জন্য অনুমতি ছাড়া এটি এত বড় হওয়ায় সুযোগ পেয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবার লাইসেন্স না পেলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছিল। সবাই জানে, এর সুবিধাভোগী কে ছিল। এখন গরিব মানুষের বেহাত হওয়া টাকা যে পথে আদায় করা যায়, সরকারকে সে পথে এগোতে হবে। একই সাথে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যাবস্থা করতে হবে।

Share.