ডেস্ক রিপোর্ট: নতুন সংঘাতের কারণে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর আফগান শান্তি প্রক্রিয়া ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায়ে আরও সংকটের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
ওয়াশিংটন এবং তালেবানের মধ্যে সই হওয়া দোহা শান্তি চুক্তি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুনর্মূল্যায়ন করতে পারেন বলেও মত তাদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ১৯ বছর ধরে চলা সংঘাত নিরসনে ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় ওই চুক্তি সই হয়।আনাদোলু এজেন্সিকে পেশোয়ারভিত্তিক আফগান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রাহিমুল্লাহ ইউসুফজাই বলেন, দোহা শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন সংকটের মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। এছাড়া, আন্তঃআফগান আলোচনা সত্যিকার অর্থে এগোয়নি। সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে।উভয়পক্ষ শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি সংঘাত বেড়ে যাওয়ার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে ওয়াশিংটন এবং তালেবান। ইউসুফজাই বলেন, নতুন তৈরি হওয়া পরিস্থিতির কারণে আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করতে পারে বাইডেন প্রশাসন।দোহায় আন্তঃআফগান শান্তি আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে সোমবার শান্তি চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ওয়াশিংটন তালেবানকে দায়ী করে। তালেবানও যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তি চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য পাল্টা দায়ী করে।তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, অসামরিক এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। হামলা বন্ধ না হলে প্রতিশোধ নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সোনি লেগেত্ত, তালেবানের অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়েছেন। হামলাকে আত্মরক্ষামূলক অভিহিত করে সব পক্ষকে সংঘাত কমিয়ে আনার জন্য পুনরায় আহ্বান জানান তিনি।এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য তালেবানকে অস্বীকার করা, হামলা এবং সরকারি কর্মকর্তা, সামাজিক প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে।ইউসুফজাই বলেন, মার্কিন নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে মে মাসের পর আফগানিস্তানের মাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারে বাইডেন বিলম্ব করতে পারেন অথবা কিছু সংখ্যক সেনা রেখে দেয়ার উপর জোর দিতে পারেন।নভেম্বরে মার্কিন গণমাধ্যম জানায়, বাইডেন বলেছিলেন, আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধে আমরা ক্লান্ত। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এ যুদ্ধ শেষ করা উচিৎ ছিল। যে দায়িত্বশীলতায় আমাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে হুমকি আর কখনো ফিরে আসবে না তা নিশ্চিত হয়।ফেব্রুয়ারিতে তালেবান-ওয়াশিংটনের মধ্যে চুক্তি হয়। যে চুক্তিতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে দীর্ঘ আফগান যুদ্ধ সমাপ্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় ওয়াশিংটন। ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের নিশ্চয়তাও দেয়া হয় চুক্তিতে।ডেমোক্র্যাটদের একটি অংশ চায় না আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করতে। মে মাসের পর এক বা দুটি মার্কিন ঘাঁটি দেশটিতে রাখতে বাইডেনের উপর চাপ তৈরি করতে পারেন তারা। ইউসুফজাই বলেন, আফগানিস্তনে সংঘাত বেড়ে যাওয়াকে দোহা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন বাইডেন।আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন না হলেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন কাবুলভিত্তিক বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার সাঈদ ইকবাল।
আনাদোলু এজেন্সিকে তিনি বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবানকে পরাজিত করে আফগানিস্তান থেকে সম্মানের সঙ্গে প্রস্থানে ওয়াশিংটনের যে চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, গেল কয়েক বছরে সে পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নতুন প্রেসিডেন্টের অধীনে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে পরিবর্তন আসতে পারে।‘প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার খুব করে চাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন যেন আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব তাড়াহুড়ো না করে।’ বলেন ইকবাল।
‘শান্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়বে না’
নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং মার্কিন প্রশাসন পরিবর্তন হলেও শান্তি প্রক্রিয়া উল্টে যাওয়ার মতো কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সালমান বাশির।২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন বাশির। আনাদোলু এজেন্সিকে তিনি বলেন, আমি মনে করি ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয়েই আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার হতে চাচ্ছে। বাইডেনকে আফগানিস্তান এবং এই অঞ্চলের ভূ-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। কারণ এছাড়া বিকল্প কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিকল্প কোনো উপায়, শান্তির অপার সম্ভাবনাকে ব্যহত করবে, গৃহযুদ্ধের দিকে ঢেলে দিয়ে আফগানিস্তানকে একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।বাশির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একা আফগানিস্তানের জটিলতা নিরসন করতে পারবে না। তাদের প্রয়োজন রাশিয়া, চীন এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা। যাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা আসা সংকটের স্থায়ী সমাধান হয়।একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন ইউসুফজাই। তিনি বলেন, সংঘাত বাড়লেও নতুন প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে ট্রাম্পের নেয়া পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে বদলাবেন বলে মনে হয় না। তিনি চাইলেও সেটা করবেন না, কারণ দোহা চুক্তিতে মার্কিন রাজনৈতিক, সামরিক বাহিনী এবং অন্য সংশ্লিষ্টদেরও সমর্থন রয়েছে।তালেবানও যুদ্ধ নিরসন চায় বলেও জানান তিনি।
বাইডেন কি করবেন?
চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার বিষয়ে বাইডেন কি ধরনের কৌশল অবলম্বন করবেন সে বিষয়ে মন্তব্য করা খুবই কঠিন বলে মন্তব্য করেন নিউইয়র্কভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক জেরে ভ্যান ডাইক।সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘ইন আফগানিস্তান অ্যান্ড ক্যাপটিভ’-এর লেখক জেরে ভ্যান ডাইক আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, বাইডেন কি করবেন? তার ঘনিষ্ঠরা ছাড়া, বাইরের কেউ এ বিষয়ে কিছু জানেন না।২০০৮ সালে তালেবানের হাতে আটক হয়েছিলেন ভ্যান। তিনি বলেন, ট্রাম্প বিদায় নিচ্ছেন, তিনি কি ভাবছেন সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডেমোক্র্যাটরা আসছে, তারা চায় না, আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে।‘এখন বিষয় হলো, তালেবানকে পরিবর্তনে তারা কি করবে? আরও সেনা আফগানিস্তানে পাঠাবে কি না? সেনা বাড়িয়ে কোন কাজ হয়নি। ট্রাম্পও তাদের ওপর বোমা ফেলেছেন, ফল আসেনি। তালেবান কখনো হাল ছেড়ে দেবে না, যুক্তরাষ্ট্রও না।’ বলেন ভ্যান।ট্রাম্পের বিদায়ের পর ওয়াশিংটনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী জালমে খালিলজাদ কাজ করবেন কি তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন ভ্যান। বলেন, আমি তেমনটা মনে করি না, তবে সত্য কি আমি জানি না। এটা ঠিক খালিলজাদকে তার প্রাপ্ত সম্মান দেয়া হয়নি।
‘সংকট সমাধান প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান, ইরান এবং সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধে মার্কিনীরা ক্লান্ত। তবে মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং সিআইএ এটাকে যুদ্ধে পরাজয় হিসেবে দেখতে পারে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং ইরান সহায়তা করবে কি না এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ বলেন ভ্যান।আফগানিস্তান ইস্যুতে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা ভালো করেই জানে আফগানিস্তানে পুরানো ভূমিকায় ফিরতে চায় মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির পুতিন, খুব করে চাচ্ছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে।