দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক ব্যর্থ, সিদ্ধান্তের জন্য পুতিনের দিকে চোখ

0

ডেস্ক রিপোর্ট: যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লুর উদ্যোগে দেশটির আন্তালুনিয়ায় ত্রি-পক্ষীয় এই বৈঠকের দিকে নজর ছিল সবার। কারণ দুই পক্ষ সিদ্ধান্ত বা সমঝোতায় পৌঁছালে যুদ্ধবিরতির দিকেই যেত পরিস্থিতি। তবে বৃহস্পতিবারের সেই বৈঠক শেষ হয়েছে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়াই। মানবিক দিক বিবেচনা করে ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি চেয়েছিল দিমিত্রি কুলেবা। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ল্যাভরভ। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বৈঠকে ইউক্রেনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ল্যাভরভ জানান ইউক্রেন ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ছাড়া রাশিয়ার অন্য কেউ থাকতে পারে। বিশ্লেষকরা ল্যাভরভের এই মন্তব্যকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করছেন। কারণ তার অনুমতি ছাড়া ল্যাভরভের পক্ষে যুদ্ধবিরতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসম্ভব। তবে ল্যাভরভ জানান, ইউক্রেনে মানবিক সংকট সমাধানে অবিলম্বে ‘যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর করা প্রয়োজন। দ্রুত সংকট নিরসনে উভয় দেশের মধ্যে আরও আলোচনা হওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই সাংবাদিক সম্মেলনে পরিকল্পনামাফিক হামলা চলবে বলে জানান তিনি। তার মতে, এটি একটি ‘বিশেষ অপারেশন’ এবং তা পূর্ব পরিকল্পনামাফিক চলবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অবশ্য বৈঠক নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। তার ধারণা ছিলো, বৈঠক শেষে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে যাবে দেশ দুটি। কিন্তু বাস্তবে তা আর হলো না। বৈঠকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান বন্ধে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলো রাশিয়া। দাবি গুলো ছিল, ইউক্রেনের সংবিধান সংশোধন করে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং কোনো ধরনের সামরিক জোটে যোগ দেয়া যাবে না। এই দাবি মেনে নেয়াকে রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করার শামিল বলে মনে করছে ইউক্রেন। ইউক্রেন চায় যুদ্ধ বন্ধ হোক। কিন্তু তাদের দাবির মধ্যে আরও আছে ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করা। অঞ্চল দুটির স্বাধীনতা স্বীকৃতি ব্যতিত রাশিয়া যেটা করতে আগ্রহী নয়। দেশ দুটির দাবি বিপরীত হওয়ায় এগোয়নি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। ইউক্রেনের বাইরে অন্য দেশের ওপর হামলা করার ব্যাপারটি নাকচ করে দিয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তবে পশ্চিমাদের ওপর উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ করে তিনি বলেন, ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে পশ্চিমারা। এমনকি ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গোপনে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ করছেন ল্যাভরভ। তবে এ দাবি অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে ল্যাভরভ বলেন, ‘এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র খুব গোপনে জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে। এ কারণে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে জীবাণু অস্ত্র সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না।’  রুশ বাহিনীর সামরিক অভিযানে হতাহত হয়েছে অনেক। ইউক্রেনের দাবি ১২ হাজার রুশ সেনা নিহত করেছে তারা। পাশাপাশি রাশিয়ার ৩৩৫ ট্যাংক, ১ হাজার ১০৫ সাঁজোয়া যান, ১২৩ কামান, ২৯ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ৪৯ যুদ্ধ বিমান, ৮১ হেলিকপ্টার, ২টি জাহাজ, জ্বালানি পরিবহনের ট্যাঙ্ক, ৬০ হাজার ৫২৬ যানবাহন বিধ্বস্ত করা হয়েছে। আগামী দিনগুলিতে ইউক্রেনে তাপমাত্রা কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। যার কারণে কিয়েভ অভিমুখী ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সেনা বহর ঠান্ডায় জমে যেতে পারে এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাল্টিক সিকিউরিটি ফাউন্ডেশনের জেষ্ঠ্য প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ গ্লেন গ্রান্ট। নিউজ উইককে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যদি ইঞ্জিন না চলে তাহলে সামরিক বহরের থাকা ট্যাঙ্কগুলো রুশ বাহিনীর জন্য বিশালাকার রেফ্রিজারেটরে পরিণত হবে। তখন নিজেদের বাঁচাতে ট্যাংক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রুশ সেনাদের। কেননা তাপমাত্রা কমে গেলে একেকটা ট্যাঙ্ক ৪০টন ফ্রিজারে রূপ নিবে। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ভাইসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি বলেন, ‘আমরা যে শক্তিশালী পুতিন এখন তা দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের শুধু কিছু সময় প্রয়োজন।’ বিশ্লেষকদের ধারণা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়তো তার বক্তব্যে তাপমাত্রা কমে যাবার অপেক্ষার কথাই বলছেন। তবে যুদ্ধ থামিয়ে পুতিনকে আলোচনায় আসার আহ্বান করার দিকেই জোর দিয়েছেন জেলেনস্কি। সামরিক অভিযানে বিপাকে বেসামরিকরা। এদিকে ইউক্রেনে সামরিক হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। মারিওপোলে ফের গোলাবর্ষণের খবর দিয়েছে বিবিসি। আবাসিক এলাকাতেও হামলার খবর পাওয়া গেছে। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের দাবি, মানবিক ত্রাণ নিয়ে গাড়ি মারিওপোলে পৌঁছানোর পথে হামলার শিকার হয়। যার কারণে সেখানে অবরুদ্ধ থাকা নাগরিকদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে দেশ দুইটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জানিয়েছেন, তারা উভয়েই মানবাধিকার সঙ্কট নিরসনে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছেন। বেসামরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সাতটি মানবিক করিডোরের ঘোষণার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইরইয়ানা ভেরেশ্চুক। এদিকে জাতিসংঘের হিসেব মতো মার্চের ৮ তারিখ পর্যন্ত ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৯০৩ জন ইউক্রেনিয়ান শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে পোল্যান্ডে, ২ লাখ ৫৩ হজার ২২২ জন গিয়েছে হাঙ্গেরি, ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩০৩ জন স্লোভাকিয়ায়, ৯৯ হাজার ৩০০ জন রাশিয়ায়, ৮৫ হাজার ৪৪৪ জন রোমানিয়ায়, ৮২ হাজার ৭৬২ জন মলদোভায়, ৫৯২ জন বেলারুশে এবং আরো ২ লাখ ৩৫৫ হাজারের বেশি ইউক্রেনিয়ান ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানালেন জাতিসংঘের মহাসচিব। মারিওপোলের শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ। ইউক্রেনের অভিযোগ, যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা অবস্থায় হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। যার কারণে অন্তত ১৭ জন আহত হয়েছে। এই ঘটনাকে ভয়াবহ উল্লেখ করলে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে টুইট বার্তা দিয়েছেন গুতেরেজ।

 

Share.