নারী ইন্সপেক্টরকে ১৮ দিন ধর্ষণ করেন এসপি: মামলার বর্ণনায় যা রয়েছে

0

ঢাকা অফিস: পিবিআইয়ে কর্মরত পুলিশ সুপার (এসপি) মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে তারই সহকর্মী এক নারী ইন্সপেক্টর ‘বিয়ের প্রলোভনে ফুসলিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ’ এনে মামলা দায়ের করেছেন। যে ঘটনা বিভিন্ন মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। যা নিয়ে নানান গুঞ্জন চলছে এবং মানুষের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে- দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওই নারী কর্মকর্তাকে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ দিন ধর্ষণ করেছেন এসপি মোক্তার। এমন পরিস্থিতিতে ওই নারী কর্মকর্তার দায়ের করা অভিযোগের বর্ণনা তুলে ধরা হলো।আদালতের দাখিল করা আবেদনে ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা এসপি’র বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উল্লেখ করেন-

দারপুরে ক্যাম্পে

ওই নারী ইন্সপেক্টরের অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি দায়িত্বরত অবস্থায় সুদানের দারপুর ক্যাম্পে ভিন্ন তারিখে ৩ দিন ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী- সুদানের নর্থ দারপুরে এসসিসি-৫, সুপার ক্যাম্পে তার বাসায় ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর আনুমানিক দুপুর ৩টায় এবং এর দুই দিনের মাথায় ২২ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় তাকে ধর্ষণের ঘটনা। এর কিছুদিন পর ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি মৌখিকভাবে বিয়ে করে পরবর্তীতে নিকাহ রেজিস্ট্রি করার প্রলোভন দিয়ে আবারও ধর্ষণ করা হয়।

সুদানের খার্তুম হোটেলে

অভিযোগ অনুযায়ী- সুদানের খার্তুম হোটেলে টানা ৫ দিন তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন- ২০২০ সালের ২৬ থেকে ৩০ জুন টানা ৫ দিন সুদানের খার্তুম হোটেল শামলোতে তাকে ধর্ষণ করা হয়।

উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ানে

নারী কর্মকর্তার অভিযোগ অনুযায়ী- উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ানে বিভিন্ন তারিখে ৫ দিন ধর্ষণের শিকার হন তিনি। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন-২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা থেকে পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টা পর্যন্ত হোটেল ডি মেরিডিয়ান লিমিটেডের ২০৬ নম্বর কক্ষে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওই বছরেরই ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত একই হোটেলের ৩০৬ নং কক্ষে আবারও ধর্ষণের শিকার হন।

মিরপুরের গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলে

অভিযোগ অনুযায়ী মিরপুরের গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলে নিয়েও তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর মিরপুর-১ এর গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেল লিমিটেডের ৭০৫ নম্বর কক্ষে তাকে ধর্ষণ করা হয়।

শান্তিনগরের হোটেল হোয়াইট হাউজে

রাজধানীর শান্তিনগরের হোটেল হোয়াইট হাউজেও ওই নারী কর্মকর্তাকে টানা ৪ দিন ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। দায়ের করা অভিযোগ অনুযায়ী- ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শান্তিনগরের হোটেল হোয়াইট হাউজের ২০৯ নম্বর কক্ষে তাকে ধর্ষণ করা হয়।

কাবিনের দাবিতে গেলে মধুমতি অফিসার্স কোয়ার্টার্সে হুমকি

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ১২ এপ্রিল আসামির বাসা এইচ-০৯, রাজারবাগ মধুমতি অফিসার্স কোয়ার্টার্সে বাদিনীকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়।

আদালতে দাখিল করা ওই নারী কর্মকর্তার বিস্তারিত অভিযোগে বলা হয়-

আসামি মোক্তার হোসেন বাংলাদেশ পুলিশের পুলিশ সুপার জাতিসংঘের শান্তিমিশনে বাংলাদেশ পুলিশের কন্টিনজেন্ট এর কমান্ডার হিসাবে ২০১৯ সালের মে মাসে সুদানে নিযুক্ত হন। বাদিনী সুদানে উক্ত মিশনের পূর্ববর্তী সদস্য হিসাবে কর্মরত থাকা মিশন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় আসামি বিভিন্ন অজুহাতে বাদিনীর সহিত সহযোগিতা নেওয়ার নাম করে যোগাযোগ করতেন।

বাদিনী সরল বিশ্বাসে নিজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সার্বিক দাপ্তরিক সহযোগিতা প্রদান করতেন। আসামি বাদিনীকে তার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে বললে বাদিনী লজিস্টিক অফিসার হিসেবে আসামিকে একটি বাসার ব্যবস্থা করে দেন।

খাবার খাওয়ার সুযোগ

একপর্যায়ে আসামি নিজে রান্না করে খেতে পারেন না, তার খাওয়া-দাওয়ার খুবই কষ্ট হয় এবং রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন এমন কথা বাদিনীকে জানিয়ে বাদিনীর সাথেই খাবার খাওয়ার সুযোগ দিতে অনুরোধ করেন। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের একজন মানুষ এবং নিজের একজন বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে আসামিকে নিজ বাসাতেই খাওয়াতে রাজি হন বাদিনী।এভাবেই আসামি নিয়মিত বাদিনীর বাসায় খাওয়া দাওয়া করতেন। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই আসামি বাদিনীকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত তার নিজ স্ত্রীর সাথে পারিবারিক কলহের বিষয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত কথোপকথন করতে উদ্যত হন। বাদিনী আসামিকে বারবার বুঝাইতে চাইতেন যে- বাদিনী আসামির কাছ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা আশা করেন না। বাদিনী আসামিকে বিভিন্ন ইঙ্গিতে এটিও বুঝাতে চান যে- বাদিনীর স্বামী আসামির বাদিনীর বাসায় আসা-যাওয়া, খাওয়া ও অপ্রয়োজনীয় কথা পছন্দ করেন না। তবুও আসামি বাদিনীর সাথে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালাতে থাকতেন।

সেদিন ক্যাম্পে যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল

এক পর্যায়ে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আসামি বাদিনীর বাসা হতে বেরিয়ে গেলে বাদিনী বিশ্রাম নিতে থাকেন। এর ১ ঘণ্টা পর আসামি বাদিনীর দরজা নক করলে ঘুমের ঘোরে বাদিনী দরজা খুললে আসামি বাদিনীর বাসায় প্রবেশ করে সোফায় বসে বাদিনীকে বাদিনীর ব্যবহৃত গাড়ির চাবিটি দিতে বলেন।ওই সময়ে বাদিনী ইউনিফরমের প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করতে গেলে আসামি বাদিনীকে পেছন দিক দিয়া জাপটে ধরেন। এই সময় বাদিনী আত্মরক্ষার্থে ঘরময় ছুটে বেড়ানোর এক পর্যায়ে আলমারির চিপায় আশ্রয় নিলে আসামি বাদিনীকে জোর করে টেনেহিচড়ে বের করে এনে আলমারির পার্শ্ববর্তী টেবিলের উপর বাদিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।

ক্ষমা চাইতে গিয়ে আবারও ধর্ষণ

এরপর এই ঘটনা কাউকে না জানাতে বাদিনীকে ভয়ভীতি দেখান ওই এসপি। পরবর্তীতে বাদিনীর সাথে দেখা করে আসামি বাদিনীর কাছে ক্ষমা চাইতে বারবার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর বাদিনীর বাসায় গিয়ে আগের ঘটনার জন্য বাদিনীর কাছে ক্ষমা চান। পরক্ষণেই আসামি আগের মতো আচরণ করে ওইদিনই দুপুর ১টায় বাদিনীর বাসায় বাদিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। এই ঘটনার পর বাদিনী আসামিকে আর বাদিনীর বাসায় ঢুকতে দিতেন না। কিন্তু আসামি সবসময় বাদিনীর বাসার দরজা উচ্চশব্দে ধাক্কাধাক্কি করতেন এবং টেলিফোন করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাদিনীর সাথে দেখা করতে চাইতেন।

দরজা ধাক্কাধাক্কির বিষয়টি টের পেয়েছিলেন অন্যরা

বাদিনীকে জরুরি কথা বলার নাম করে ফোনে জোর করে বাদিনীর বাসায় আসামি প্রবেশ করতে চাইলে বাদিনী আসামিকে বাদিনীর বাসায় প্রবেশ করতে দিতে চাইতেন না। বাদিনী আসামিকে বারবার বলেন “…আপনি আমার দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে আমার বাসায় ঢুকতে দিব না। আপনি আমার বাসায় ঢুকে আমাকে জোর করে ধর্ষণ করেছেন।. .আমি আপনাকে নিষেধ করার পরও আপনি আমার বাসায় জোর করে ঢুকতে চাচ্ছেন কেন? দয়া করে আপনি চলে যান।”ওই সময়ে দরজা ধাক্কাধাক্কির কারণ জানতে পাশের অন্যান্য বসবাসকারীরা বাদিনীকে জিজ্ঞাসা করতে বাদিনী মানসম্মানের ভয়ে কাউকে কিছুই জানাতে পারেননি।

ডিপার্টমেন্টাল হয়রানির ভয়ভীতি

আসামি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, বাদিনীকে অসহায় ও ভীতসন্ত্রস্ত করে এবং ডিপার্টমেন্টাল হয়রানির ভয়ভীতি দেখিয়ে বাদিনীর বাসায় প্রবেশ করে বাদিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছেন। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি আসামি বাদিনীকে ফুসলিয়ে, ভুল বুঝিয়ে, প্রতারণা করার উদ্দেশ্য মুখে কালেমা পড়ে বাদিনীকে মৌখিকভাবে বিয়ের প্রতারণা করেন এবং বাদিনীকে আশ্বস্ত করেন- বাংলাদেশে ফিরে এই মৌখিক বিয়েকে রেজিস্ট্রি কাবিন করে গ্রহণ করবেন বলে আবারও বাদিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।

একসঙ্গে দেশে ফিরে উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ানে

পরবর্তীতে বাদিনীকে সঙ্গে করে ছুটি নিয়ে দেশে এনে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক রাত ১১টা থেকে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ানের ২০৬ নম্বর কক্ষে বাদিনীকে আসামি বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেন। এরপর ছুটি শেষে সুদানে গিয়ে ওই বছরেরই ২৬ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সেদেশের খার্তূম হোটেল শামলোতে বাদিনীকে আসামি বিবাহের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেন।

আবারও ছুটিতে ওই নারী ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে করে দেশে ফেরেন এসপি। তিনি আগের মতোই ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ান লিমিটেডের ৩০৬ নম্বর কক্ষে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেন।আসামির দেওয়া পূর্ব আশ্বাসের ভিত্তিতে বাদিনী আসামিকে মৌখিক নিকাহ রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দিলে আসামি বাদিনীর সাথে অশোভন আচরণ শুরু করে এবং এক পর্যায়ে কৌশলে বাদিনীকে এড়িয়ে যেতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে বাদিনী চলতি বছরের ১২ এপ্রিল আসামির রাজারবাগের মধুমতি এইচ-০৯ বাসায় উপস্থিত হয়। এসময় তিনি ওই এসপির দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী বিয়ের কাবিন সম্পন্ন করতে পুনরায় তাগিদ দেন। এক পর্যায়ে আসামি কাবিন সম্পন্ন করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং আসামি, আসামির স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে বাদিনীকে মারধর করেন ও বাদিনীকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। এমন পরিস্থিতিতে বাদিনী অসহায় হয়ে পড়ে এবং বুঝতে পারে যে- আসামি বাদিনীর সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় প্রথমে বাদিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে এবং পরবর্তীতে বাদিনীর সাথে প্রতারণা করে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বাদিনীকে ধর্ষণ করেছে।অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, এই বিষয়ে বাদিনী গত ১০ আগস্ট উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে মামলা গ্রহণ না করে আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেয়।

Share.