সোমবার, ডিসেম্বর ৩০

প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, শপথ ও সংবিধান

0
শহীদুল্লাহ ফরায়জী: আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দেশের ২৪ তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর ‘২৩
রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নিয়োগ দেন। এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কারণ সংবিধানের ৯৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-  কোনো বিচারক ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর ৬৭ বছর পূর্ণ হবে ২৫ সেপ্টেম্বর।
অর্থাৎ ২৩তম প্রধান বিচারপতি স্বীয় পদে বহাল থাকা অবস্থায় ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ওবায়দুল হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হলেও, তাঁকে অপেক্ষমান থাকতে হবে বর্তমান প্রধান বিচারপতির মেয়াদ অবসান হওয়া পর্যন্ত। আর এই নিয়োগ কার্যকর হবে গেজেট প্রকাশের দিন থেকে নয়; শপথ গ্রহণের দিন থেকে।  এ কারণে ২৪ তম প্রধান বিচারপতি ২৬ সেপ্টেম্বর হয়তো শপথ গ্রহণ করবেন। প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) বলা হয়েছে- এই সংবিধানের অধীন, যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথ গ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর থেকেই তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হবে। তৃতীয় তফসিলে উল্লেখিত কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভারগ্রহণের পূর্বে  শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা  ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন, যাহা সংবিধানের ১৪৮ ( ১) অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশে শপথ গ্রহণ সাংবিধানিকভাবে আবশ্যকীয় করা হয়েছে- ১) রাষ্ট্রপতি ২) প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতি-মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ৩) স্পীকার ৪) ডেপুটি স্পীকার ৫) সংসদ- সদস্য ৬) প্রধান বিচারপতি বা বিচারক ৭) প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার ৮) মহা হিসাব- নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক ৯) সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যগণ। এক নম্বর ক্রমিক থেকে পাঁচ নম্বর ক্রমিক পর্যন্ত ব্যক্তিগণ পদের বিপরীতে নির্বাচিত হবেন এবং ছয় থেকে নয় নম্বর ক্রমিক পর্যন্ত ব্যক্তিগণ পদের বিপরীতে নিযুক্ত হবেন। ‘নির্বাচিত’ এবং ‘নিযুক্ত’ উভয় ব্যক্তিগণ শপথ গ্রহণের সাথে সাথে কার্যভার গ্রহণ করিবেন। কারণ নির্বাচিত এবং নিযুক্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক শপথ গ্রহণ শেষ হওয়া মাত্রই কার্যভার গ্রহণের অধিকারী হয়ে যান।
বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শপথ নেবেন স্পীকারের নিকট, প্রধানমন্ত্রী-সহ মন্ত্রিপরিষদ  এবং স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার শপথ নেবেন রাষ্ট্রপতির নিকট, সংসদ সদস্যগণ শপথ  নেবেন স্পীকারের নিকট, প্রধান বিচারপতি শপথ নেবেন রাষ্ট্রপতির নিকট এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল/হাইকোর্টের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যগণ শপথ নেবেন প্রধান বিচারপতির নিকট।
আমাদের সংবিধান প্রধান বিচারপতিকে ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত করেছে, ,যা সংবিধানের ৯৪ (২) অনুচ্ছেদ দ্বারা নিশ্চিত। বিদ্যমান সংবিধান বিচার বিভাগে ‘বিচারপতি’ হিসেবে শুধুমাত্র প্রধান বিচারপতিকে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য  ‘বিচারক’ নির্ধারণ করেছে।
সংবিধানে ‘প্রধান বিচারপতি’র পদ ছাড়া  কোথাও বিচারপতি শব্দ প্রয়োগ করা হয়নি, আর সকল সময় বিচারক শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, সংবিধানে ইংরেজিতে Chief justice এবং Other judges হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শপথ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘প্রধান বিচারপতি’ নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে  শপথ নেবেন আর অন্যান্যগণ ‘বিচারক’ হিসেবে নিযুক্ত হয়ে সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ নিবেন। যে পদের বিপরীতে শপথ নিয়ে শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন সেই পদবী   উল্লেখ করাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
প্রধান বিচারপতি পদকে সংবিধান খুবই মর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বারবার উপস্থাপন করেছে। আমাদের সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে, প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। শুধুমাত্র অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়েছে। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কার্যভার প্রদানের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারি কর্তৃপক্ষ। প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক  নিযুক্ত হলেও অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দানে প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দান করিবেন।
বিচারক পদের মেয়াদ তিন ক্ষেত্রে শেষ হবে ১) ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হলে ২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে ৩) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিলে। বিচারকদের পদের মেয়াদ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ, ‘৭২ সালে সংবিধান প্রবর্তনের পর পরিবর্তিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। চতুর্থ সংশোধন,The second proclamation order থেকে চতুর্দশ সংশোধন, পঞ্চদশ সংশোধন, সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধন করা হয়েছে।
‘৭২ সালের সংবিধানে বিচারকের বয়স ৬২ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবার কথা ছিল। চতুর্দশ সংশোধনীতে তা ৬৫ এবং পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা ৬৭ বছর করা হয়েছে।
১৯৭২ সালে যখন সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল তখন বিচারক অপসারণের আইন সংসদের উপর ন্যস্ত ছিল অথচ এই সংবিধানের আওতায় ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করে, তখন বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পণ করা হয়েছিল।
‘৭২ সালে যাহা ছিল সংসদের উপর ন্যাস্ত, একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় চতুর্থ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাহা রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা অপসারিত করা যাইবে- এই বলে সংবিধান সংশোধন  করা হয়।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সেই ক্ষমতা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’র কাছে অর্পণ করেছিল রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা বাতিল করে।
সর্বশেষ  ষোড়শ সংশোধনীতে আবার ‘৭২ সালে প্রবর্তিত  সংবিধানের বিধান পুনস্থাপিত করা হয়।
ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ করার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ কোর্ট জাতীয় সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখেছে। এর আগে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ এই সংশোধনী বাতিল করেছিলো। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে উচ্চ আদালত। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ হলেও আজ পর্যন্ত সরকার সেই সংশোধনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে  সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করেছে। এই হচ্ছে সংবিধানের প্রতি সরকারের আনুগত্যের দৃষ্টান্ত।
আবার শপথ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পেয়েও শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষমান থাকবেন বর্তমান প্রধান বিচারপতির মেয়াদ অবসান না হওয়া পর্যন্ত- এটা হচ্ছে জ্বলন্ত উদাহরণ।
তেমনি কিছুদিন পূর্বে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে গেজেট হওয়ার পরও শপথ নিয়ে কার্যভার গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। এটাই সংবিধানের নির্দেশনা।
কিন্তু দশম এবং একাদশ সংসদের সদস্যগণ
নির্বাচিত হয়ে গেজেট প্রকাশের তিনদিনের মধ্যে শপথ নিয়ে নেন পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্বেই। ফলে সংসদ  এবং সরকার  গঠন অবৈধ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত হয়েও পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতির মেয়াদ অবসান না হওয়ার কারণে শপথের জন্য অপেক্ষমান থাকবেন, আর সংসদ সদস্যগণ পূর্ববর্তী সংসদের মেয়াদ অবসান না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষমান থাকবেন না, এটা কোনো সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক সভ্য রাষ্ট্রে চিন্তাও করা যায় না। অথচ দশম ও একাদশ সংসদের ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে।
সংসদ সদস্যদের শপথ সংক্রান্ত রিটে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাগণ সংবিধানকে সুরক্ষা দেননি, বরং সংসদ সদস্যদের শপথের মাধ্যমে কার্যভার গ্রহণ অস্বীকার করে-  সংসদ অধিবেশনের দিন শপথ কার্যকর হবে ব’লে  সংবিধান বহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন। এই মোতাবেক আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরও সংবিধান লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এই ধারাবাহিক সংবিধান লঙ্ঘনের প্রক্রিয়া বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। গুরুতর সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্নটি নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আদালতের নজরে আনবেন এবং সর্বোচ্চ আদালত সংবিধান লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা নিষিদ্ধ করবেন।
অন্যদিকে বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে তাঁদেরকে অপসারণে ষোড়শ সংশোধনী, না সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় প্রয়োগ হবে-  তাও সুস্পষ্ট করা উচিত। সংসদ সদস্যদের শপথ ও বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সাংবিধানিক জটিলতা নিরসন করা আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্যই জরুরী।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক।
Share.