বাসায় এসি-গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে যেভাবে সাবধান থাকবেন

0

ঢাকা অফিস: নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি মসজিদে গত শুক্রবার বিস্ফোরণের ঘটনার পর এসি ব্যবহার, গ্যাসের লাইনের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা করতে দেখা গেছে ব্যবহারকারীদের। নারায়ণগঞ্জে দুর্ঘটনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে মসজিদে থাকা এসি বিস্ফোরণের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তবে পরবর্তী সময়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে মসজিদটির মেঝের নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাসের পাইপে ফুটো (লিকেজ) থাকায় মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। গ্যাসের লাইনে লিকেজ থাকা, এসি বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা দেশে প্রায়ই ঘটে থাকে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলো ঘটে বাসাবাড়িতে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে। বাসাবাড়িতে সাধারণত যেসব কারণে আগুন লাগে এবং দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব বিষয়ের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন, সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

বৈদ্যুতিক গোলযোগ: বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট যত অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তার সিংহভাগের উৎস বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে হওয়া মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৯ ভাগই ছিল বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, বিদ্যুতের লোড অনুযায়ী কেব্‌ল ব্যবহার না করা, মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার না করা, ভবনের নকশায় দুর্বলতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে একটি ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে ভবনগুলোতে বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ ভবনের ওয়্যারিং সিস্টেমের চেয়ে বেশি লোড দেওয়া।’ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে আশি বা নব্বইয়ের দশকের এ রকম বহু পুরোনো ভবন রয়েছে, যেগুলোর ওয়্যারিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল সে সময়কার চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাপ নেওয়ার জন্য। তখন আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ছিল, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারও কম ছিল।’‘পুরোনো ওয়্যারিং সিস্টেমের একটি ভবনে যদি এসি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, স্মার্ট টিভির মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ওই ওয়্যারিং সিস্টেম লোড নিতে পারবে না এবং শর্টসার্কিটের ঝুঁকি তৈরি হবে,’ যোগ করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসি কেনার সময় ভালো করে যাচাই-বাছাই করে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের এসি কেনা উচিত। এ ছাড়া ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার জন্যও অনেক সময় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান আরো বলেন, ‘ছোট ছোট বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, যেমন মাল্টিপ্লাগ বা সকেট কেনার ক্ষেত্রে আমরা টাকা বাঁচাতে কম দামিগুলো কিনে থাকি এবং মাল্টিপ্লাগে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিনের মতো ভারী যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করি। এই কমদামি মানহীন মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করা বা একটি প্লাগে একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র সংযুক্ত করে চালানো শর্টসার্কিটের একটি বড় কারণ।’ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। দীর্ঘ সময় এসি চালিয়ে রাখার ফলে ভবনের বৈদ্যুতিক সক্ষমতার ওপর চাপ পড়তে পারে, যেখান থেকে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।আবার দীর্ঘ সময় লাইট বা ফ্যান অন করে রাখা, কম্পিউটার বা টেলিভিশনের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ না করার ফলেও শর্টসার্কিটের সূত্রপাত হতে পারে।বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টিসহ প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার পরামর্শ দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এসি কেনার ক্ষেত্রে টাকা বাঁচাতে গিয়ে আমরা অনেক সময়ই ভালো ব্র্যান্ডের এসি না নিয়ে নন-ব্র্যান্ডের সস্তাগুলো নিয়ে থাকি। কিন্তু সেটি আসলে পেশাদার মেকানিক তৈরি করেছেন, নাকি ধোলাইখালের মতো জায়গায় তিন-চারটি নষ্ট এসি থেকে ভালো অংশগুলো নিয়ে তৈরি হচ্ছে, তা আমরা জানি না। তাই এ রকম যন্ত্র কেনার সময় দাম বেশি হলেও ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য কেনা উচিত।’

গ্যাসের লাইনে ত্রুটি: গ্যাসের লাইনে ত্রুটি থাকার কারণে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে প্রায়ই শোনা যায়। দীর্ঘসময় গ্যাসলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ না করা, অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে গ্যাস বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট অগ্নিকাণ্ডের অন্তত ১৮ ভাগের উৎস ছিল চুলার আগুন থেকে। তবে সংস্থাটির অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, এগুলোর সিংহভাগেরই কারণ ছিল ব্যবহারকারীদের অসতর্কতা ও অসচেতনতা। তবে গ্যাসের লাইনে সমস্যা থাকার কারণেও রান্নাঘর থেকে বাড়িতে আগুন লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শহরের বস্তি এলাকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় চুরি করে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নেওয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়তো গ্যাসের সংযোগ ত্রুটিপূর্ণ থাকে। এ রকম সংযোগ থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়।’নিয়মিতভাবে বাসার গ্যাসের সংযোগ মেকানিকের মাধ্যমে পরীক্ষা করার পাশাপাশি লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে অতিসত্বর যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন জিল্লুর রহমান।

গ্যাস সিলিন্ডার: বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। বাংলাদেশে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, রান্নার কাজে ব্যবহার করা গ্যাস সিলিন্ডারের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। যেসব গ্রাহক সিলিন্ডার ব্যবহার করেন কিংবা মাঠ পর্যায়ে যাঁরা ডিলার, তাঁদের অনেকেই সিলিন্ডারের ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন না। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির মতো রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রেও কমদামি এবং মানহীন সিলিন্ডার কেনার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে মন্তব্য করেন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরির কাজ করা একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সেইফ সিলিন্ডার ক্যাম্পেইন’-এর প্রধান মশিউর খন্দকার। মশিউর খন্দকার বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়, সেগুলোর অনেকগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে তৈরি করা হলেও অনেক সিলিন্ডারই নকল হয়ে থাকে। এই নকল সিলিন্ডারগুলোর ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি হয়।’রান্নার জন্য দেশের অনেক জায়গায় এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।‘আবার অনেক সময়ই মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সিলিন্ডারগুলোর সাধারণত ১০ বা ১৫ বছরের মেয়াদ থাকে। ওই মেয়াদের পরেও সেগুলো ব্যবহার করা হলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা থাকে,’ যোগ করেন মশিউর খন্দকার। আবার অনেক সময় সিলিন্ডার পরিবহনও যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী না করায় সেগুলোতে ত্রুটি দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যবহারকারীদের কিছু ভুলের কারণেও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন মশিউর খন্দকার। মশিউর খন্দকার বলেন, ‘বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় গ্যাস সিলিন্ডার রান্নাঘরে চুলার নিচে বদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। বদ্ধ পরিবেশে না রেখে খোলামেলা জায়গায় সিলিন্ডার রাখলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম থাকে।’ মশিউর খন্দকার আরো বলেন, একটু লম্বা পাইপ ব্যবহার করে বারান্দায় সিলিন্ডার রাখার চেষ্টা করা উচিত ব্যবহারকারীদের। এ ছাড়া সিলিন্ডার কাত করা বা সোজা করে না রাখার ফলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে বলেন তিনি।মশিউর খন্দকার বলেন, ‘অনেক সময়ই দেখা যায় গ্যাস শেষ হয়ে গেলে সিলিন্ডারের পুরো গ্যাস ব্যবহার করার জন্য মানুষ সিলিন্ডার কাত করে, ঝাঁকিয়ে আবার সেটি ব্যবহার করে। কাত করলে তরল গ্যাস সিলিন্ডারের মুখে চলে আসতে পারে, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’মশিউর খন্দকার বলেন, সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক করছে কিনা, তা বোঝার জন্য পাইপের কাছে নাক নিয়ে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।

পানির ট্যাঙ্ক ও সেপটিক ট্যাঙ্ক: বাংলাদেশে পানির ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ বা সেপটিক ট্যাঙ্কের বিষাক্ত গ্যাসের কারণে হতাহতের ঘটনা খুব বেশি শোনা না গেলেও এ ধরনের দুর্ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে থাকে। ২০১৮ সালে ঢাকার মিরপুরে পানির রিজার্ভ ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে একই ভবনের পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার পর ট্যাঙ্কের নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এর আগেও পানির ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে আগুন বা বৈদ্যুতিক টর্চ জালানোর পর জমে থাকা গ্যাসের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সেপটিক ট্যাঙ্কে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে নামা ব্যক্তিদের মৃত্যুর বেশ কয়েকটি ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে এ কাজে পেশাদার ব্যক্তি বা সংস্থাকে ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

Share.