ঢাকা অফিস: বিএনপির রাজনীতিতে একসময় তারা ‘দাপুটে’, আর এখন ‘কোণঠাসা’ হয়ে দলীয় চিত্রপটের অনেকটাই বাইরে। তবুও তাদের কেউ মূল্যায়নের প্রত্যাশায়, আর কেউবা ‘দলকে দিতে’ পেতে চান ‘দায়িত্ব’। কেউ আইনি ঝামেলা মোকাবেলার পাশাপাশি সময় দিচ্ছেন নিজ এলাকায়, আবার কেউ মানুষের ভালোবাসাকেই দিচ্ছেন গুরুত্ব। বিএনপির রাজনীতিতে নানাভাবে উল্লেখযোগ্য অথচ এখন পাদপ্রদীপের বাইরে থাকা এই চার নেতা হলেন—এহসানুল হক মিলন, মজিবর রহমান সরোয়ার, নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও মিজানুর রহমান মিনু। দলের দুঃসময়ের এই কাণ্ডারিরা দলেই কার্যত কোণঠাসা। কেন্দ্র থেকে যথাযথ সম্মান প্রাপ্তি তো দূরের কথা, পদাবনতি, পদ হারানোর মতো ঘটনারও মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। কেন এমন ভাগ্যবরণ তাদের? সুস্পষ্ট কারণ জানা নেই কারো। এ নিয়ে তাদের দুঃখবোধ আছে; আছে অভিমান। কারো আবার প্রত্যাশাও নেই কোনো। যতটুকু পেয়েছেন মূল্যায়ন, তা নিয়ে সন্তুষ্ট। আবার দলের মূল্যায়ন পাবার প্রত্যাশাও জারি রাখছেন কেউ। তাদের মধ্যে এহসানুল হক মিলনের সময় যাচ্ছে সপ্তাহে দুদিন আদালতে ধরনা দিয়ে আর দুদিন বিশ্রাম নিয়ে। বাকি দিন সময় দেন নিজ এলাকা চাঁদপুরের কচুয়ায়। মজিবর রহমান সরোয়ার থাকেন কেন্দ্রের নির্দেশনার অপেক্ষায়। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। তবে মনে করেন, বিএনপিকে তার দেওয়ার আছে অনেক। এজন্য দায়িত্ব চান তিনি। দলের প্রতি অভিমান নিয়েও নজরুল ইসলাম মঞ্জু আশাবাদী—দল তাকে মূল্যায়ন করবে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলেন—এখনো তাদের নিয়েই কাজ করেন। মিজানুর রহমান মিনু পারিবারিক সহায়-সম্পত্তি দেখভালের পাশাপাশি আছেন এলাকার মানুষের সঙ্গে। মানুষের ভালোবাসাই তার কাছে বড় পাওয়া। দলের কাছে প্রত্যাশার প্রশ্নে তার সংযোজন, ‘মানুষের প্রত্যাশার তো শেষ নেই।’ এহসানুল হক মিলন: সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। গত ৬ এপ্রিল এই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। করা হয় নির্বাহী সদস্য। আকস্মিক এই পদাবনতির কারণ আজও খুঁজে পাননি মিলন। হঠাৎ কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তে আর সবার মতো অবাক হয়েছেন তিনিও। বুধবার কথা হয় তার ঢাকাটাইমসের সঙ্গে। বললেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে সাতটি বই লিখেছি। তাতে আমার পদাবনতি হয়েছে। আরও কয়েকটি বেশি লিখলে কী হতো জানি না।’ দলে একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন মিলন। নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরের কচুয়াতেও তার অনুসারী-অনুগামীদের রাখা হয়নি বিএনপি বা অঙ্গ-সংগঠনগুলোতেও। তার মতে, ‘কোণঠাসা নয়, মাইনাস করে রেখেছে আমাকে।’ একই সঙ্গে তার সংযোজন, ‘আমি বিএনপিতে জন্ম নিয়েছি। এই দলকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। বিএনপি আমার দল, আমাদের দল। আমি বিএনপি করেছি, করেই যাবো। নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে আমাকে। এই সদস্য পদ নিয়ে নিলেও আমি দলের কাজই করব। ১৯৮০ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতি করছি। আমৃত্যু করতে থাকব।’ তার মন্তব্য চাঁদপুর ও কচুয়া বিএনপিতে বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে কেন্দ্র থেকেই। বললেন, ‘চাঁদপুর বিএনপি এবং কচুয়া বিএনপির রাজনীতিতে বিভক্তি করা হলো। ইচ্ছেকৃত করা হলো এটা। একটা সুন্দর রাজনীতি ছিল, এটা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’ কেন করা হলো এটা? মিলনের জবাব, ‘বলতে পারব না। এটা আমার কাছে দশক আশ্চর্য। কেউ স্বউদ্যোগে নিজের দলকে ধ্বংস করে এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী?’ সময় কীভাবে কাটছে এখন? অকপট বললেন, ‘প্রত্যেক সপ্তাহে দুদিন যায় চাঁদপুরের আদালতে হাজিরা দিয়ে। পরের দুদিন বিশ্রামে থাকতে হয়। তারপর লেখালেখি করি। শরীর ভালো লাগলে সন্ধ্যায় জিমে শরীর চর্চা করি।’ তার অভিযোগ, মালয়েশিয়া প্রবাসী মোশারফ হোসেনকে কেন্দ্র থেকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। অথচ মাঠ পর্যায়ে তার কোনো ভিত্তি নেই। বললেন, ‘কেন্দ্র কমিটি সব কমিটি দিয়ে রেখেছে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোশারফ হোসেনের কাছের লোকদের। আসলে তার তো দেশে কোনো সক্রিয়তা নেই। বিদেশেই থাকে। কিছু ব্যক্তিকে নিয়মিত বেতন দিয়ে তার পক্ষে রাখে। তারপরও আমি আমার মতো সংগঠন গোছাচ্ছি।’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান মিলন। ব্যস্ত সময় কাটছে মাঠ গোছাতে। কচুয়ায় রীতিমতো সময় দিচ্ছেন শতভাগ। তার ভাষায়, ‘নির্বাচন যদি হয় তাহলে তো অংশ নিতে হবে।’
মজিবর রহমান সরোয়ার: বরিশাল সদর আসন থেকে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মজিবর রহমান সরোয়ার। এটি ১৯৯১ সালের কথা। ১৯৯৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত আবদুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাস বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য হন। তার মৃত্যুর পর আবারও উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সরোয়ার। প্রায় তিন দশক ধরে বরিশাল বিএনপিতে একক আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল বরিশাল মহানগর বিএনপি কমিটি। কিন্তু ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর বরিশাল মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। সেখানে বাদ দেওয়া হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সরোয়ারকে। ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির কারণে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলা হলেও, সরোয়ার একথা মানতে নারাজ। বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বা অন্য দলগুলোতে যারা তৃণমূলে আছেন তাদের কেন্দ্রেও পদ আছে। বিএনপিতে এ ধরনের নীতি থাকার প্রয়োজন কি আমি বুঝে উঠতে পারি না।’মজিবর রহমান সরোয়ার বরিশাল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, মহানগর সভাপতি, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছাড়াও বরিশাল সিটি মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া সংসদ সদস্য ও সংসদের হুইপও ছিলেন তিনি। তারপরও কেন বরিশাল বিএনপি থেকে ছিটকে পড়লেন তিনি? ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমি বরিশাল অঞ্চলে রাজনীতি করি। আমার বিকল্প যাদের মনে করেছে দল, তাকেই বেছে নিয়েছে। বরিশালে আমি ১৮টি প্রতিষ্ঠান করেছি। বিএনপির বহুতল ভবনে অফিস করে দিয়েছি। ইউনিয়ন পর্যায়ে বিএনপির অফিস করে দিয়েছি। আওয়ামী লীগেরও তো এত বড় অফিস নেই।’ ‘রাজনীতিতে আমার একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। যার যে সমস্যা নিয়ে এসেছে সমাধান করে দিয়েছি। এক ২৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি, দল যখন ক্ষমতায় ছিল। তারপরও যদি তাদের বিকল্প ইচ্ছে হয় তাহলে কিছু করার নেই।’ তবে আগের চেয়ে রাজনৈতিক ব্যস্ততা তার কমেছে, জানালেন সে কথাও। মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘আগে যেমন পূর্ণকালীন মহানগর বিএনপির সভাপতি হিসেবে ব্যস্ততা ছিল। এখন তো কেন্দ্রে পূর্ণকালীন লাগে না।’ বাকি জীবন বিএনপির রাজনীতিতে কাটিয়ে দিতে চান উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, ‘বিএনপির জন্য আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। দুবার প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলাম। আমার তো এখন বিএনপির জন্য করা দরকার। এজন্য দায়িত্ব দিলে ভালো হয়। দায়িত্ব না দিলে তো করা মুশকিল।’
নজরুল ইসলাম মঞ্জু: খুলনা মহানগর বিএনপির ঘোষিত কমিটির সমালোচনা এবং পুনর্বিবেচনার দাবি জানানোয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ হারিয়েছেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। প্রায় চার যুগ ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় মঞ্জু হঠাৎ করেই ছিটকে পড়লেন দল থেকে। তবে এ নিয়ে অভিমান আছে তার। তিনি মনে করেন, যা বলেছেন দলের ভালোর জন্য বলেছেন। দল এক সময় ঠিকই তা বুঝবে। বুধবার ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘৪৪ বছর দেশের একটি অঞ্চলে বিএনপিকে সুসংগঠিত করেছি। এখন দলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে আমি দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। তাই আমার মতামত জানিয়েছি।’ মঞ্জু বলেন, ‘দল আমাকে পদ বঞ্চিত করলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমি আছি। তাদের নিয়েই কাজ করছি। আমি মনে করি বিএনপি ভালো মানুষের দল। সততা ও নিষ্ঠার দল। সেই দলটি ভালোভাবে চলবে। মানুষের কল্যাণে কিছু করবে। ‘এ দেশের মানুষ দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি চায়। আগামীদিনের সময়োপযোগী রাজনীতির জন্য জনগণের প্রত্যাশাকে পূরণ করে এমন রাজনৈতিক দল গঠন করা উচিত। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, এখনো সামনে সময় আছে। এজন্য সঠিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।’ দলের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি কি আস্থা নেই? জবাবে বলেন, ‘দলের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে রাজনীতি করেছি, করছি এবং ভবিষ্যতেও করব। এখনো আশাবাদী যে কথাগুলো আমি বলেছি সেগুলো দল মূল্যায়ন করবে।’ যদিও সম্প্রতি নতুন করে সমালোচনার শিকার হয়েছেন পদ্মাসেতু নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে। এটিকে দলের কেউ কেউ তার সমালোচনা করলেও সাধুবাদও দিয়েছেন অনেকে।
মিজানুর রহমান মিনু: বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। একসময় রাজশাহী বিএনপির ডাকসাইটে এই নেতা এখন দলে অনেকটাই কোণঠাসা। তবে তিনি মনে করেন রাজনৈতিক জীবনে এখন পর্যন্ত যা পেয়েছেন, তা কম নয়। মিনু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার ভোট ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ। রাজশাহী-২ আসনে। মানুষের ভালোবাসা, মায়া মমতা আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। একজন রাজনীতিকের জীবনে এটা বড় পাওয়া।’ দলের কাছে আর কোনো প্রত্যাশা কি নেই? জবাবে বলেন, ‘নেই। বিএনপি তো বিশাল দল। সমপর্যায়ের অনেক নেতা আছেন। সবাইকে একসঙ্গে একত্রিত করারও তো বড় চ্যালেঞ্জ। আমিও পারব না। এখন এর মধ্যেই সহ্য করে থাকতে হয়। তবে আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।’ আক্ষেপের সুরও ছিল কণ্ঠে, ‘কপালে থাকতে হবে। আল্লাহ যখন চান হবে। এটা সৃষ্টিকর্তার কৃপায় হয়।’ মিনু জানান, পারিবারিক সহায়-সম্পত্তি, পরিবারকে সময় দিতে হয়। এর বাইরে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ-সম্পর্ক রেখে চলেন। বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতি এবং জাতীয় পর্যায়েও সক্রিয় আছি। যারা মাঠে তাদের তো দল মূল্যায়ন করেই। দল তো একটা বিশাল আন্দোলন, সংগ্রামের পথ পাড়ি দিচ্ছে। কখনো সফলতা, কখনো সামনে এসেও পিছিয়ে যেতে হয়। এত বড় একটি দল। সবাইকে সুসংগঠিত করাও তো সহজ কাজ নয়।’ ১৯৭৯ সালে ছাত্রদলের প্রাথমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (জাগ ছাত্রদল) গঠন হলে রাজশাহী জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হন মিজানুর রহমান মিনু। ১৯৮২ সালে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এর রাজশাহী জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের রাজশাহী জেলা শাখার আহবায়ক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ১৯৯১ সালে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৯৬ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে তিনি বিএনপির রাজশাহী মহানগরীর সভাপতি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে বেগম খালেদা জিয়া তাকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনোনীত করেন। পরে ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজশাহীর মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি রাজশাহী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি পুনরায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।