ঢাকা অফিস: বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে মন্তব্য করেছেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। শনিবার (২১ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের এ নেতা । তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বের সংকটময় পরিস্থিতিতে গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পণ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে। তাই প্রস্তাবটি স্থগিত রাখার পাশাপাশি জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে সরকারের কাছে ভর্তুকির দাবি জানান তিনি। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে যারা গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন তারা মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চান। সময় থাকতে সরকারকে তা বুঝতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে জনজীবনের ওপর, যা দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তার দায়ভার তখন সরকারকে নিতে হবে। এরপরও যদি দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটি ব্যবসায়ীদের ওপর না চাপিয়ে বিদ্যুৎ খাতের তহবিল থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করা হোক। মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় নয়। যে চেষ্টা হচ্ছে, সেটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। মহামারির মধ্যে আমাদের উৎপাদন খরচ বহুগুণে বেড়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমন সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার ফলে ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং উৎপাদন উপকরণসহ সব খাতে ব্যাপক দাম বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় ও ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়েছে। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মূল্যস্ফীতির হার দুই সংখ্যার বেশি। এতে জনজীবনে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ‘একদিকে আমাদের রপ্তানি শিল্পে উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে রপ্তানি খাতে বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। আবার সঞ্চয় কমে যাওয়ার ফলে বিনিয়োগ ও ব্যাংকিং খাতের অর্থ প্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বহুমুখী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে জানিয়ে মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এর প্রভাবে কৃষি, শিল্প, সেবা এবং সার্বিকভাবে সাধারণ জনগণের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। সর্বোপরি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল ও এলএনজি’র ওপর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের সাময়িক দাম বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সমীচীন নয়। জ্বালানি তেল ও এলএনজি’র দাম পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসার পরই বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। সরকার বিদ্যুৎ খাতের তহবিল থেকে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এমন সময় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিচালনা দক্ষতা, ন্যূনতম ব্যয় এবং বিতরণে আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, শিপিং ও পরিবহন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি খাতের পক্ষে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে দাম না বাড়িয়ে কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের। পাশাপাশি বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ীরা। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে এফবিসিসিআইয়ের কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন। সুপারিশগুলো হলো: বার্ক আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আমূল সংস্কার করা। অনিয়ম, অপচয়, অবৈধ সংযোগসহ যাবতীয় অপব্যবস্থা জরুরি নিরসন করা। অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা। অহেতুক খরচ কমিয়ে আনা। বিদ্যুৎ ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করে অলস উৎপাদনকারীকে অর্থ পরিশোধ বন্ধ করা। ভর্তুকি পাওয়া জ্বালানি খাতের ওপর শুল্ক মূসক প্রত্যাহার করা। গ্যাসের মূল্য সব খাতের জন্য সাধারণ হারে নির্ধারণ করা। সরবরাহ মূল্য বিদ্যমান হারে বজায় রেখে বাড়তি ব্যয় সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে সমন্বয় করা। সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন- এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন, এমসিসিআইর সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, বিএসএমএর সভাপতি মনোয়ার হোসেন, বিসিএমএর সভাপতি মো. আলমগীর কবির সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।