ডেস্ক রিপোর্ট: পৃথিবীর প্রত্যন্ত একটি এলাকা ত্রিস্তান ডি কুনহা। এটি একটি দ্বীপ স্থানীয়দের কাছে যা সংক্ষেপে টিডিসি নামে পরিচিত। সেখানে যাওয়া খুবই কঠিন একটি কাজ। এই দ্বীপটি কেমন এবং সেখানে কারা কীভাবে থাকে তা দেখতে সেখানে যেতে চাইলে আপনা যা করতে হবে:
১. প্রথমে বিমানে করে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে যেতে হবে।
২. সেখান থেকে উঠতে হবে একটি নৌকায়।
৩. তার পর ১৮ দিন ধরে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে উত্তাল সমুদ্র। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসংকুল সমুদ্রপথের একটি এই পথ। তার পর কোন এক সময় কুয়াশা উঠে গেলে আপনি এই দ্বীপটির দেখা পেতে পারেন।
৪. নৌকা নিয়ে টিডিসি দ্বীপের দিকে অগ্রসর হবেন। নৌকাটি কূলে ভেড়ানোর জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে কখন বাতাসের গতি একটু দুর্বল হয়ে আসে তার জন্য।
৫. নৌকাটি ডাঙায় তুলে রাখতে হবে। তা নাহলে সমুদ্রের ঢেউ এটিকে দূরে কোথাও ভাসিয়ে নিতে পারে। অথবা ঢেউ-এর আঘাতে পাথরের সঙ্গে সংঘর্ষে নৌকা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
৬. এর পরই আপনি দেখা পাবেন ত্রিস্তান ডি কুনহার রাজধানী সেভেন সিজের এডিনবরার এলাকার যেখানে লোকজনের বসতি।
অবশ্য আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দ্রুত গতির নৌকাও নিতে পারেন। সুবিধা হচ্ছে এই নৌকায় সমুদ্র পথে ২,৮১০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ছয় দিন। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকও আছে আর তা হচ্ছে এই নৌকাটি বছরে মাত্র একবার ছাড়ে। এর যাত্রী সংখ্যাও সীমিত। এছাড়াও এই পথে মাছ ধরার যে সামান্য কয়েকটি জাহাজ চলাচল করে সেগুলোর কাছেও আপনি লিফট চাইতে পারেন। ত্রিস্তান ডি কুনহাতে যাওয়া অথবা সেখান থেকে ফিরে আসা ঠিক এতোটাই কঠিন। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে ত্রিস্তান ডি কুনহা দ্বীপে মোট অধিবাসীর সংখ্যা ২৪৫। তাদের মধ্যে ১৩৩ জন নারী এবং ১১২ জন পুরুষ। তারা সবাই সেভেন সিজের এডিনবরায় বসবাস করেন। সেখানে আছে একটি কফি শপ, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য একটি হল, একটি পোস্ট অফিস এবং একটি পাব। পাবটির নাম অ্যালবেট্রোস। দ্বীপটি আকারে ছোট্ট হলেও সেখানে একটি আধুনিক হাসপাতাল আছে, আছে ছোট এক স্কুল। একসময় টিডিসিতে বসবাস করতেন অ্যালেসডিয়ার উইলি। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি কখনো এই দ্বীপ ছেড়ে চলে না যান, তাহলে খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবেন যাদের সঙ্গে আপনি স্কুলে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গেই আপনাকে আপনার বাকি জীবন কাটাতে হবে।’ ত্রিস্তান ডি কুনহা এমন একটি জায়গা যেখানে হয়তো বিয়ের বহু আগেই আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আর আপনি যদি ত্রিস্তানিয়ান বা এখানকার আদি বাসিন্দাদের উত্তরসূরি হন তাহলে আপনার নামের সঙ্গে ছয়টি পদবীর যেকোনো একটি থাকতে পারে।এই নামগুলো হচ্ছে: লাভারেল্লো, রেপেত্তো, রজার্স, সোয়েইন, গ্রিন এবং গ্লাস। অধিবাসীদের মধ্যে মাত্র দুজন আছেন যারা এই দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেননি। তাদের একজন পুরুষ, আরেকজন নারী। কয়েক বছর আগে তারা দুজনেই দ্বীপের বাসিন্দাদের বিয়ে করে প্রত্যন্ত এই দ্বীপটিতে তাদের পরিবারের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখানে একজন ডাক্তার এবং একজন শিক্ষকও আছেন যাদেরকে ব্রিটেন থেকে সেখানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এই দ্বীপটি ব্রিটেনের বাইরে ব্রিটিশ-শাসনাধীন এলাকা বা ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি। হ্যারল্ড গ্রিন বলেন, ‘এখানকার পরিবেশ এতোটাই শান্ত যে সেখানে ঘাস বড় হওয়ার শব্দও আপনি শুনতে পাবেন। আর জায়গাটি এতোই নিরাপদ যে এখানে তালা বলে কিছু নেই। দ্বীপে ইন্টারনেট সংযোগ ‘খারাপ, খুবই খারাপ’। তবে ভাল দিক হচ্ছে এখান থেকে বিদেশে যতো ফোন করা হয়, যদি সংযোগ ঠিক থাকে, সেগুলো ফ্রি। দ্বীপটির উপকূল-জুড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তাও আছে। এই সড়ক ধরে খোলা একটি জায়গায় যাওয়া যায়। সেখানে জমির পর জমি।এর চারপাশে পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তীব্র বাতাস থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে এসব প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। সেখানে চাইলে আপনি কিছু সবজি চাষ করতে পারেন। বিশেষ করে আলু, বলেন সেখানকার সাবেক একজন বাসিন্দা, গ্রীষ্ম কালে আমরা সেখানে যেতে পারি। শহরের বাইরে ছুটি কাটানোর ওটাই একমাত্র জায়গা। দ্বীপের লোকজনের কাছে বারবিকিউ বা ব্রাই সবচেয়ে প্রিয় বিনোদন। আগুনে মাংস ঝলসে খাওয়াকে ব্রাই বলা হয় যা ত্রিস্তান ডি কুনহার ‘সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি’ দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতি থেকে এসেছে। দ্বীপের গবাদি পশুগুলো মূলত একাজেই ব্যবহৃত হয়। দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, একটা সময় ছিল যখন তাদের জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সঙ্গীত। বাদ্যযন্ত্র বাজানো এবং গান গাওয়াই ছিল তাদের বিনোদনের উপায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এখন স্ক্রিনেই সময় কাটাতে পছন্দ করেন, বলেন অ্যালেসডিয়ার।সুশ্যামল এই দ্বীপে ট্রেকিং বা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোও আরো একটি বড় বিনোদন। দ্বীপটি কখনোই ১০ কিলোমিটারের বেশি প্রশস্ত ছিল না। গভীর উপত্যকা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,০৬২ মিটার উপরে খাড়া পাহাড়ের কিনার ধরে হেঁটে যাওয়াও বাসিন্দারা উপভোগ করে থাকেন। আসলে এই দ্বীপে সমতল ভূমি খুব কমই আছে। চারপাশে দুই-তৃতীয়াংশ ঘিরে আছে পাথরের প্রাচীর যা খাড়া নেমে গেছে উত্তাল সমুদ্রের গভীরে। ত্রিস্তান ডি কুনহাকে অনেকেই শুধু ত্রিস্তান নামেই চেনে। একগুচ্ছ আগ্নেয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এটিই মূল দ্বীপ। এসব দ্বীপের মধ্যে একটির নাম নাইটিঙ্গেল আইল্যান্ডস যেখানে ত্রিস্তানিয়ানরা কখনো-সখনো ছুটি কাটাতে যায়। সেখানে তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে হাঙরের পাশাপাশি সাঁতার কাটা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে আরো কিছু দ্বীপ আছে যেগুলোতে সাধারণত মানুষের যাওয়া আসা নেই। তবে এরকম একটি দ্বীপ, লোকজন যার নাম দিয়েছে ইনঅ্যাকসিসেবল আইল্যান্ড, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা একটি আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন করেছে। ওই স্টেশনে কয়েকজন আবহাওয়াবিদ সারা বছর ধরে পালাক্রমে কাজ করেন। অ্যালিসডিয়ার বলেন, ‘মানুষের মনে একটা ধারণা আছে যে দ্বীপের জীবন বুঝি অনেক রোমান্টিক। কিন্তু সেখানে বসবাসের অনেক বিপদও আছে। এটা অবশ্যই সুন্দর একটি জায়গা। তবে এটি কোন স্বর্গ নয়।’ বাতাসের শীস এবং গরু ডাক ছাড়া এই দ্বীপে তেমন বেশি কিছু শোনা যায় না। তবে দ্বীপপুঞ্জের যেখানেই যাবেন সেখানেই আপনি প্রচুর পাখি দেখতে পাবেন। তবে তাদের কাউকে গান গাইতে শোনা যায় না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। চার পাশে এতো পাখি। কিন্তু পাখির কোন গান শোনা যায় না। এসব পাখি শিকার করার মতো পাখিও খুব একটা নেই এই দ্বীপগুলোতে। ফলে কিছু পাখি আছে যারা উড়াল না দিয়েও বেঁচে থাকতে পারে। এরকম একটি বিরল প্রজাতির পাখি ইনঅ্যাকসিসেবল আইল্যান্ড রেল। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রত্যন্ত দ্বীপে বসবাস করলে সেখানকার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা খুব কঠিন। আবার এলাকাটি দুর্গম হওয়ার কারণে সারা বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাও খুব সহজ। দ্বীপের একজন বাসিন্দা ফিওনা কিলপাট্রিক বলেন, ‘এই দ্বীপে কোভিড-নাইনটিনের সংক্রমণ হয়নি ঠিকই কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা এই মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হইনি।’ দক্ষিণ আফ্রিকাতে লকডাউন জারি করার কারণে সেখান থেকে যেসব জাহাজ পণ্য নিয়ে এখানে আসে এবার সেগুলো কেপটাউন ছেড়ে আসেনি। অ্যালেসডিয়ার বলেন, ‘বছরের বেশিরভাগ সময়েই এই দ্বীপে পণ্যের তেমন একটা সরবরাহ থাকে না। কিন্তু মহামারির সময়ে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে। তাদের ফল-মূল, শাক-সবজি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এটা যে খুব অস্বাভাবিক ঘটনা তাও নয়। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে কবে যে আবার সেখানে এসব যেতে পারবে কেউ বলতে পারে না।’ তবে সেখানে ত্রিস্তান লবস্টার বা বড় বড় চিংড়ির অভাব নেই। সমুদ্রের ঠাণ্ডা পানিতে এই চিংড়ি প্রচুর পরিমাণে জন্ম নেয়। এটাই তাদের উপযুক্ত পরিবেশ। দ্বীপের বাসিন্দারা সমুদ্র থেকে এই লবস্টার ধরে সেগুলো হিমায়িত করে রেখে দেয়। এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ আয় করে দ্বীপের বাসিন্দারা। এই অর্থের পরিমাণ টিডিসির মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ। কোভিড মহামারির আরেকটি দিক হচ্ছে এর ফলে ত্রিস্তান ডি কুনহা দ্বীপে গত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম সেখানে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে। অ্যালেসডিয়ার বলেন, জটিলতা এড়াতে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীরা সাধারণত দক্ষিণ আফ্রিকাতে চলে যায়। কিন্তু সেদেশে লকডাউন জারি করার কারণে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। একারণে ত্রিস্তানেই ওই শিশুটির জন্ম হয়েছে। মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছে। দ্বীপের লোকজন নতুন এই বাসিন্দাকে পেয়েও খুব খুশি। লোকজন অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ত্রিস্তান দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে সেখানে বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। তার পর থেকে সেখানে জনসংখ্যা কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। তবে গত কয়েক দশকে তাদের সংখ্যা কমতির দিকে। ‘আমি যখন সেখানে বাস করতাম তখন ১৫ জন বৃদ্ধ বৃদ্ধা মারা গিয়েছিল। কিন্তু জন্ম হয়েছিল মাত্র দুজনের,’ বলেন অ্যালিসডিয়ার, ‘তখন যে বয়স্ক লোকজনের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল এটা ছিল খুবই ভাল খবর।’ ভবিষ্যতের জন্য আরো কিছু সুখবর আছে: ‘যে তিনটি মেয়েকে মাধ্যমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার জন্য ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল, তাদের একজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাচ্ছে।’ এই মেয়েটি হবে এই দ্বীপের প্রথম কোন নারী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবে। যদিও একজন ত্রিস্তানিয়ান এর আগে দূর-শিক্ষণ পদ্ধতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আপনি যদি প্রত্যন্ত এলাকার জীবন উপভোগ করতে চান এবং সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত যে তাতে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।