ডেস্ক রিপোর্ট: ভয়াবহ ফর্কলিফট দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া এক কিশোর তার শরীরের নিচের অর্ধেক অংশ কেটে ফেলার পরও নানা প্রতিকূলতাকে হারিয়ে দিব্যি আছেন। একটি ব্রিজের ওপর ফর্কলিফট চালানোর সময় ৫০ ফুট নিচে পড়ে যান লরেন শ্যাওয়ার্স। তার শরীরের ওপর পড়ে যায় চার টনের গাড়িটি। ১৯ বছর বয়সী লরেন পুরোটা সময় সচেতন ছিলেন এবং ডানহাত বিস্ফোরিত হতে এবং তার কোমরের নিচের অংশ পুরোপুরি পিষে যেতে দেখেন। পরে জীবন বাঁচাতে হেমিকর্পেক্টোমি সার্জারি করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন তরুণ এই শ্রমিক। এর ফলে তার কোমরের নিচে সব কিছু বাদ দেয়া হয়। ডাক্তাররা বলেন, লরেনের বান্ধবী সাবিয়া রেইচে (২১) ভেবেছিলেন, তার বয়ফ্রেন্ড বাঁচবে না। এমনকি সে আর একদিনও বেঁচে থাকবে না এমন আশঙ্কায় তার কাছ থেকে ছয়বার বিদায়ও নেন সাবিয়া। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান লরেন। ওই দুর্ঘটনার ১৮ মাস আগে থেকে দুইজনের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটনার পর আরও কাছে চলে আসেন। ফলে এ বছর তারা বাগদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার গ্রেট ফলসের বাসিন্দা লরেন বলেন, ফর্কলিফটটি আমার উপর পড়ে যেতে এবং আমার দেহকে পিষে ফেলতে দেখলাম। লরেন বলেন, যত মেডিকেল পেশাদারদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা পুরো ঘটনা শুনে খুব অবাক হয়েছে, বিশেষ করে এই আঘাতের পর আমার জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প তাদের অভিভূত করেছে। আসলে আমার শরীরের অর্ধেকটা ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত খুব কঠিন ছিল না। কেননা এখানে কেবল বাঁচা বা মরার প্রশ্ন ছিল, এটা আমার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল না। ২০১৯ সালে একটি সেতুর সংস্কারের কাজের সময় একটি নির্মাণ সাইটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন লরেন। তিনি মন্টানার উইলসালের বাইরে একটি হাইওয়ে ব্রিজের উপরে একটি ফর্কলিফট চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই ট্রাফিক আইন অমান্য অনেকগুলো গাড়ি তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে শুরু করে। গাড়িগুলো তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে শুরু হওয়ার এক লেনের রাস্তা নাটকীয়ভাবে আরও সংকীর্ণ হয়ে আসে। লরেন ব্রিজে এক ধারে চলে আসেন এবং তার নিচে মাটি কেঁপে ওঠে। লরেন পড়তে থাকা ফর্কলিফট থেকে লাফ দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পা সিটবেল্টের সঙ্গে আটকে যায় এবং একটি খাড়া পাহাড়ের ৫০ ফুট নিচে পড়ে যায়। পাহাড়ের নিচে মাটিতে আঘাত করার আগে তিনবার ঘোরে ফর্কলিফটটি এবং তার দেহের ওপর পড়ে গেলে তা পিষে যায়। লরেন বলেন, যখন ব্রিজের ধার ধসে পড়ছিল এবং ফর্কলিফটি পড়তে শুরু করে আমি আমার সিটবেল্ট খুলে ফেলি এবং লাফ দেয়ার চেষ্টা করি। তিনি বলেন, আমি জানতাম এটা ভুল সিদ্ধান্ত কিন্তু এটা বাঁচার চেষ্টা ছিল। কিন্তু আমি লাফ দেয়ার পর সিটবেল্ট আমার পায়ে জড়িয়ে যায়। ফলে আমি ঝুলে যাই এবং ফর্কলিফটের ফ্লোরবোর্ডে লেগে আমার একটি পাজর ভেঙে যায়। লরেন বলেন, আমি ফর্কলিফটে উপরে থাকতে চেষ্টা করেছি এবং অবশেষে মাটিতে পড়ার পর আমি ফর্কলিফটে ছিটকে পড়ি। পুরো সময় আমি সচেতন ছিলাম। আমার চোখ খোলা ছিল এবং আমি ফর্কলিফটি আমার কোমর এবং ডানহাতের ওপর পড়তে দেখেছি। তিনি বলেন, আমার ডানদিকে তাকিয়ে দেখি ফর্কলিফটটি আমার ওপর রয়েছে এবং আমার ডানহাত আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রভাবে এটি ছিটকে পড়েছিল। সাবিয়া বলেন, পরে আমরা জানতে পারি লরেনের টিম যে জায়গায় কাজ করছিল সেখানকার মাটি খুব নরম ছিল। এজন্যই বেঁচে গেছে লরেন। তিনি বলেন, মাটি নরম না থাকলে লরেনের শরীর অর্ধেক হয়ে যেত এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর আগেই অনেক রক্ত বের হয়ে যেত। তবে মাটিতে থাকা ময়লা নরম হওয়াটাই সেই পরিস্থিতিতে তার জীবন বাঁচিয়েছিল। একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেতুতে অবতরণ করে এবং মন্টানার বোজম্যানের একটি হাসপাতালে লরেনকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার প্রিয়জনের সঙ্গে তার দেখা হয়। দুর্ঘটনায় লরেনের ডান বাহু এবং ডান হাত পুরোপুরি হারাতে হয়। এসময় তার কলারবোন ও কাঁধও ভেঙে যায়। দুর্ঘটনায় লরেনের পালমোনারি এম্বোলিজম হয় এবং তার শ্বাস নেয়ার জন্য নলের প্রয়োজন হয়। লরেন বলেন, তারা ভেবেছিল যে আমার নিচের অংশ এখনও সারিয়ে তোলা সম্ভব। ডাক্তাররা আমার মূল শিরাগুলো বেঁধে দেন এবং পুরো শরীরের স্ক্যান করেন। পরে তারা দেখতে পান যে আমার পুরো পেলভিস পিষে গেছে। আমাকে ওয়াশিংটনের সিয়াটেল স্থানান্তর করা হয়, যেখানে তারা আমার ডান কোমর, গোপন অঙ্গ এবং বাম উরু অপারেশন করে। যখন তারা আমার পেলভিসের অবস্থা দেখতে পেলো তখন তারা হেমিকোরপোরেক্টোমি সার্জারি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। লরেন বলেন, তখন তারা আমার সম্মতি নিয়ে আমার শুক্রাণু সংরক্ষণের চেষ্টা করে কিন্তু এটি সম্ভব হয়নি। এসময় ডাক্তাররা সাবিয়া ও তার পরিবারকে লরেনের কাছ থেকে বিদায় নিতে বলেন। সাবিয়া বলেন, লরেন হাসপাতালে থাকার প্রথম মাসের আমাদের মধ্যেই অনেক ভারাক্রান্ত, কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়ার কথোপকথন হয়েছিল। তিনি বলেন, লরেনের অপারেশনের আগের রাতে একটি কাগজের টুকরোতে সে লেখে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’, কেননা এটাই আমাদের একসঙ্গে শেষরাত হতে পারে। আজও আমার কাছে ওই কাগজের টুকরো রয়েছে। অনেকবার ডাক্তাররা আমাদের বলেছেন যে, লরেন হয়তো মারা যাবে। তাই আমরা ‘ভালোবাসা’ এবং এ সংক্রান্ত অনেক কথোপকথন করেছি। সাবিয়া বলেন, ডাক্তাররা বলতো সে মারা যাবে, আমরা তখন বিদায় নিতাম এবং সে মারা যেতো না। এটা খুব বিরক্তিকর ছিল, সত্যি বলতে গেলে কি, আমরা এটাকে ঘৃণা করতাম। তার স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা খুব আতঙ্কিত ছিল, এই মনে হচ্ছিল সে মারা যাচ্ছে, কিন্তু সে শেষপর্যন্ত বেঁচে আছে। দুর্ঘটনার এক মাস পর লরেনকে মন্টানার একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় যাতে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে পরিদর্শন করতে পারে, কারণ ডাক্তাররা তখনও মনে করছিলেন যে, লরেন মারা যাবে। তবে তার স্বাস্থ্য অবিশ্বাস্য গতিতে ভালো হতে শুরু করে। ডাক্তাররা ভেবেছিলেন লরেনকে কমপক্ষে এক বছর হাসপাতালে থাকতে হবে কিন্তু তিনি চার সপ্তাহের পুনর্বাসনের আগে মাত্র তিন মাস হাসপাতালে অবস্থান করেছিলেন এবং এরপর বাড়ি ফিরে যান লরেন। এসময় লরেন নিজে নিজে তার ‘বালতি’ প্রোসথেটিক এবং কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই হুইলচেয়ারে উঠা শেখেন। সাবিয়া বলেন, এই পুরোটা সময় নিজে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে চলার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে অত্যন্ত উদ্ভাবনী ছিল লরেন। আমাদের নতুন জীবনে যে কোনও সময় প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে লরেন নিজেই একটি উপায় বের করে, যা একজন ‘সাধারণ’ মানুষও সাধারণত ভাবেন না। তিনি বলেন, যদি আমি তার অবস্থানে থাকতাম তাহলে হতাশার অন্ধকারে ডুবে যেতাম। অনেক মানুষ এসব বিষয়কে বিভিন্নভাবে সামলেছে এবং আমার মনে হয় লরেন মানসিক ও শারীরিকভাবেই সব প্রতিকূলতাকে পরাজিত করেছে। সে নিজের এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য তার জীবন স্বাভাবিক করতে সবরকম চেষ্টা করেছে, তার এই বিষয়টা আমি খুব ভালোবাসি। এই ভয়াবহ ঘটনার পরও সে নিজের মতোই আছে, তার কোনও পরিবর্তন হয়নি, স্বাধীনভাবে যা করা যায়, তার সবটাই সে নিজে নিজে করে। আমি তার জন্য সত্যিই গর্বিত। এই বছরের শুরুর দিকে সাবিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেন লরেন এবং বাগদান সম্পন্ন করেন। ২০২১ বা ২০২২ সালের ১৭ জুলাই বিয়ে করতে পারেন এই দম্পতি। সাবিয়া বলেন, একসঙ্গে এটা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের সম্পর্কের অনেকগুলো দিক মজবুত হয়েছে। তিনি বলেন, দম্পতি হিসেবে এতদিন যেসব বিষয়কে কম মূল্য দিতাম, এসব জিনিসকে আমরা মূল্য দেয়া শুরু করি। লরেন বলেন, দুর্ঘটনার আগের তুলনায় পরের জীবনযাত্রা অনেকটা সাধারণ করে তুলেছি। কারণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শুয়ে কাটাতে হয়। দুর্ঘটনার প্রায় তিন মাস পরে অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি সত্যিই কতটা ক্রেজি এবং আশ্চর্যজনকভাবে আমি এখনও বেঁচে আছি। লরেন বলেন, প্রথমে আমরা বিশ্ব ঘুরে দেখতে চাই এবং এরপর সন্তান নিতে চাই এবং তাদের আমাদের চেয়েও ভালো মানুষ বানাতে চাই; এমন স্বাভাবিক জীবনই চাই। তিনি বলেন, এই বছরের শুরুতে আমি সাবিয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ওইদিনটি সাবিয়ার খুব খারাপ যাচ্ছিল। আমি তার পেছনে ঘুরার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রিং বের করে ফেললাম এবং এটি তার নজরে পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর জিজ্ঞাসা করলাম, সে আমাকে বিয়ে করতে চায় কিনা। যদি কেউ এমন কিছুর মধ্য দিয়ে যায়, তাহলে তার জন্য আমার সর্বোত্তম পরামর্শটি হলো আপনি যাই কিছু করেন না কেন তাতে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। তাই যা আছে তাই দিয়ে জীবন পুরোপুরি উপভোগ করুন।
বেঁচে থাকার জন্য শরীরের অর্ধেকটা কেটে ফেলেন মার্কিন এই তরুণ
0
Share.