গেল সপ্তাহে মিশরে সিনেট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেননি দেশটির ৫ কোটি ৪০ লাখ ভোটার। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে মিশরের নির্বাচন কমিশনকে। পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ঘটনা তদন্তের। সিদ্ধান্ত হয়েছে যারা ভোট দেননি তাদেরকে পাবলিক প্রসিকিউটরের আদালতে হাজির করার।
‘খবরটা যখন পত্রিকায় পড়ছিলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছে এটা ভুয়া, ধাপ্পবাজি। নির্বাচন কমিশন প্রধানের বিবৃতি শুনে বিস্মিত হয়েছি। তিনি ভোটারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যার পাশাপাশি আইনের ভিত্তি তুলে ধরছিলেন।’ বলেন, এক ভোটার।
২০১৪ সালে মিশর একটি আইন পাস করে। ভোট দিতে ব্যর্থ হলে ৫০০ মিশরীয় পাউন্ড জরিমানার বিধান রাখা হয়। সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে অংশ নেয়নি ৫ কোটি ৪০ লাখ ভোটার। যা দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক। মোট ভোটারের ৮৫ শতাংশ। যদি সবার কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রের অর্জিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ১০৫ কোটি মিশরীয় পাউন্ড।
মিশরে সিনেটের বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। এটি একটি আলঙ্করিক কমিটি মাত্র। জাতীয় রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার কোনো ভূমিকাও নেই। সম্প্রতি মিশরের সংবিধান সংশোধন করা হয়। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। সংশোধনীতে সিনেট কীভাবে গঠিত হবে তার রূপরেখাও নির্ধারণ করা হয়। সিনেটের গঠনতন্ত্র এমনভাবে ঠিক করা হয়েছে, যাতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। একে অযৌক্তিক বলেছেন বিশ্লেষকরা।
মিশরের সিনেটে ৩০০টি আসন রয়েছে। ১০০ জনকে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট আল সিসি নিজে। ক্লোজড লিস্ট সিস্টেমে নির্বাচিত হন আরো ১০০ জন। বাকি ১০০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচত হয়।
যারা সরাসরি ভোটে অংশ নেন তারা সিসির দি ন্যাশনস ফিউচার এবং তাদের জোট সঙ্গীর প্রার্থী। সিসি এবং তাদের জোট সঙ্গীদের পরামর্শে মনোনীত প্রার্থীরাই সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়। অর্থাৎ বিজয়ীরাও সিসির অনুসারী।
গণতন্ত্রের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যদি ৮৫ শতাংশ ভোটার ভোটদানে অংশ না নেয় তাহলে সবদলের উচিৎ অতিসত্ত্বর পরাজয় মেনে নেয়া। কারণ প্রার্থীরা ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্র এবং বাস্তবতায় এখন আকাশ পাতাল ব্যবধান। বর্তমানে সিসি সরকারের আমলে গণতন্ত্রহীনতার মুখোমুখি মিশর।
কেনো ৮৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করলো না? কেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হলো? এসব নিয়ে দেশটিতে কোনো আলেচনাই চলছে না। বরং যারা ভোট দেয়নি তাদের কাছ থেকে কীভাবে জরিমানা আদায় করা হবে তা নিয়ে সরকারপন্থী গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে। টেলিভিশনে টকশো হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে সাড়ে ৫ কোটি ভোটারকে কীভাবে পাবলিক প্রসিকিউটর হেডকোয়াটার্স বিচারের আওতায় আনেবে তার ফর্মুলা নিয়ে।
জরিমানার অর্থ অভিযুক্তদের কাছ থেকে আদায়ে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন আইনবিদরা। ১. ন্যাশনাল আইডেন্টেটি কার্ডের জন্য আবেদন করার সময়। ২. যখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবে। ৩. কেউ যখন জরিমানা পরিশোধ করবে সে তথ্য বাকিদের পাঠিয়ে দিতে হবে। তাতে সাড়া না দিলে চাকরিজীবীদের বেতন থেকে জরিমানার অর্থ কেটে নেয়া হবে।
ইতোমধ্যে সরকার একটি প্রচারণা শুরু করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, পাবলিক প্রসিকিউশন অফিস সাড়ে ৫ কোটি ভোটারের উপস্থিত হতে বলেছে।
২০১৪ সালে মিশর তাদের সংবিধানে আর্টিকেল ৬৫ নামে একটি ধারা সংযুক্ত করে। যেখানে বলা হয়ে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারবে। যদিও বর্তমান মিশর সরকার তার স্বীকৃতি দিচ্ছে না। দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে।
স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন, সিসির ইচ্ছা এবং তার পরিকল্পনা প্রচারই হলো কথা বলার বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কিছু বলা অপরাধ।
২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সরকার নির্বাচনের বৈধতা এবং জনগণের ভোটাধিকারের ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ সংকটে ভুগছে। ওই বছর প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নেন সিসি। তার আগে দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তিনি। বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রহসনের নির্বাচিনের মাধ্যমে নিজের প্রেসিডেন্সি রক্ষা করে চলছেন সাবেক সেনা প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আলি সিসি।
সিনেট নির্বাচনের ফলাফল বা ভোটার উপস্থিতি সিসির জন্য তেমন কিছু নয়। দেশটিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন আসন্ন। সেখানে এ ধরনের ভোটার অনুপস্থিতি হয়তো দেখতে চাইছেন না প্রেসিডেন্ট সিসি।
সিসির অধীনে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রয়েছে মিশরের জনগণ। দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি জনগণ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এ অবস্থায় যারা ভোট দেননি তাদের থেকে ৫০০ পাউন্ড জরিমানা আদায় মিশরীয়দের দুর্দশাকে আরো বাড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।