মা হওয়ার পরও আব্বা আমাকে ভাত মেখে খাওয়াতেন: শেখ হাসিনা

0

গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায়: ঢাকায় আমরা এলাম ১৯৫৪ সালে। আমি আর কামাল। জামাল ছিল খুব ছোট। আর প্রথমবার আমরা এসেছিলাম ১৯৫২ সালে। তখন ভাষা আন্দোলন হয়। আব্বা ছিলেন জেলখানায়। তখন খবর পেলাম, আব্বার শরীর খুব খারাপ। তখন দাদা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের নিয়ে ঢাকা আসবেন, আমরা তখন নৌকায় করে ঢাকা এসেছিলাম। আমার দাদার বড় নৌকা ছিল। তাতে দুটি কামরা ছিল। তিন মাল্লার নৌকা। আমি আর কামাল আমরা ছোটবেলায় দৌড়াদৌড়ি করতাম। নৌকার মধ্যে হাঁটতে পারতাম। নৌকার ভেতরেই রান্নাবান্না হতো। খাওয়াদাওয়া হতো। যখন ঝড় আসত কিংবা পাশ দিয়ে স্টিমার যেত, নৌকা যে দুলত, দাদি আমাদের ধরে রাখতেন। আমার খুব মনে আছে। ঢাকায় আসতে আমাদের চার দিন লেগেছিল।

শেখ মুজিব যখন বাবা: আমার আব্বা এত বড় নেতা হলে কী হবে, যতটুকু সময় পেতেন আমাদের যত্ন নিতেন। আমি যখন আমার জীবনে ছেলেমেয়ের মা, তখনও কিন্তু আব্বা ভাত মাখিয়ে দিতেন; আমি বসে বসে খেতাম। আসলে আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর যেটা হয়েছে, আমরা দেখতাম আব্বা জেলখানায়। ছাড়া পেলে তার সঙ্গে দেখা হতো। দেখতাম বক্তব্য দিতেন। এটাই ছিল আমাদের জীবন। বেশিরভাগই দাদা-দাদির কাছে।১৯৪৯ সালে আব্বা যখন গ্রেপ্তার হন, তিনি ছাড়া পাননি, একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলখানায়। তাকে যখন জেলে নেওয়া হয়, তখন আমার ছোট ভাইটি (শেখ কামাল) খুবই ছোট। আব্বাকে তখন সেভাবে দেখার সুযোগ পায়নি। কাজেই আমি যখন আব্বা আব্বা বলে কাছে যেতাম, ছোট ভাই খুব অবাক হয়ে দেখত। তখন জিজ্ঞেস করত, তোমার আব্বাকে কি আমি একটু আব্বা বলতে পারি? এটাই ছিল আমাদের জীবন।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: দিনরাত সারাক্ষণ ওই রাস্তাভর্তি মিছিল। সারাক্ষণ মানুষ আর মানুষ। আব্বা এই গাড়িবারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। কোনো ক্লান্তি ছিল না। এই কোনার রুমে টেলিফোন ছিল। ওখান থেকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার কথা মুখে বলে দেন। এই প্রচারটা যখন পাকিস্তানের ওয়্যারলেসে ধরা পড়ে, তারা ৩২ নম্বরের বাসায় দ্রুত চলে আসে এবং আব্বাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তখন থেকে অপেক্ষার পালা। হঠাৎ আমরা খবর পেলাম, ৮ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পেয়েছেন এবং সেখান থেকে সরাসরি লন্ডন চলে গেছেন। তারপর তিনি ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) ফিরে আসেন। আমরা অপেক্ষা করে আছি। কামাল, জামাল, আমার দাদা, রাসেল সবাই এয়ারপোর্টে যায়। লাখো মানুষ। সমস্ত রাস্তা মানুষে মানুষে ভরা। আমার মা রেডিওর পাশে বসা। এসেই তিনি প্রথমে চলে যান তার জনগণের কাছে। আমাদের কাছে তিনি আসার পর। যখন তিনি আসেন সত্যিকার অর্থেই তখন একতালা বাসা। তখন দুটো কামরা ছিল। মা তার কামরায় বসেছিলেন। আমরা তখন সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আব্বা এলেন, আমাদের সবাইকে আদর করলেন। আমরা সবাই ছিলাম বাকরুদ্ধ। আমাদের চোখে পানি। মনে আনন্দ। তখন আমাদের যে কী এক অনুভূতি। এই যে ফিরে পাওয়াটা। এই ফিরে পাওয়াটা আমাদের জন্য কত মূল্যবান ছিল। আমরা নানা কথা শুনতাম। উনাকে মেরে ফেলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফিরে এসে তিনি সবাইকে আদর করার পর যখন মায়ের কাছে গেলেন, মা বাবাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন মনে হলো যেন তিনি জীবনের সব পাওয়া পেয়ে গেছেন।

খন্দকার মোশতাক প্রসঙ্গে: খন্দকার মোশতাক ষড়যন্ত্র করতে পারে, এটা আব্বা জানতেন। বরং যখন তাজউদ্দীন চাচা চলে গেলেন। বাবার জন্য এটা খুব দুঃখজনক ছিল। সে সময় আমি হঠাৎ কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম যে, ঠিক আছে যখন তাজউদ্দীন চাচা চলে গেছে তাতে কী হয়েছে। মোশতাক চাচা তো আছেই। এ কথা শুনে আব্বা যা বললেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে বললেন, মোশতাককে কি তুই চিনিস? ও তো সুযোগ পেলে আমার বুকে ছুরি মারবে। অর্থাৎ আব্বা জানতেন, কে কী করতে পারে।

১৫ আগস্টের ফোন: সকালে একটা ফোন বাজল। পনেরো আগস্ট সকালবেলা। ফোনের আওয়াজটা আমার মনে হয়, এত কর্কশ ফোনের আওয়াজ আমি জীবনে শুনিনি। আমরা যে রুমে ছিলাম, ও নেমে গেছে। ঠিক সে সময় ফোন। হোস্ট ফোনটা ধরলেন। তারপর আমাকে বললেন, তোমার হাসবেন্ডকে ডাকো। আমি বললাম, কেন কী হয়েছে আমাকে বলেন। বলল, না। তাকে ডাকো। তখন শুনলাম দেশে ক্যু হয়েছে। ক্যু হয়েছে শুনে আমি বললাম, তাহলে তো কেউ আমাদের বেঁচে নেই। ঠিক এইটুকু আমার মুখ থেকে এলো। তারপর থেকে যেকোনো ফোন বাজলেই খুব হঠাৎ বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠত। কেমন যেন অন্যরকম কষ্ট যে ফোনের আওয়াজটাই সহ্য করতে পারতাম না।

বেলজিয়াম থেকে জার্মানি: হুমায়ুন রশীদ সাহেবকে অ্যাম্বাসাডর সানাউল হক সাহেব বললেন যে আপনি যে বিপদটা আমার ঘাড়ে দিয়েছেন, এখন নিয়ে যান। আমাদেরকে উনারা বর্ডারে পৌঁছে দেওয়ার কথা। উনি নিজে গাড়িটা দিলেন না। সোজা বলে দিলেন যে গাড়িটা নষ্ট। তখন আরেকজন অফিসার ছিলেন। উনার স্ত্রীর সঙ্গে ক্লাস সেভেন থেকে একসঙ্গে পড়তাম। সে ভদ্রলোক একটু খাতির করলেন। তখন বেলজিয়াম ভাষায় নিউজ হচ্ছে। বারবার টিভিতে আব্বার ছবি দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা কোনো ভাষা বুঝতে পারছি না। তো, বেলজিয়ামের বর্ডারে নামলাম। তারপর নো-ম্যান্স ল্যান্ডে হেঁটে আমাদের মালপত্র সব হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন করে আমরা ওপারে যাই। হুমায়ুন রশীদ সাহেব উনার সেক্রেটারিকে পাঠিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে, কারণ চার-পাঁচ ঘণ্টা যেতে হবে। আমাকে রাতে হুমায়ুন রশীদ সাব আলাদা ডেকে নিলেন। বললেন, তুমি একটু আসো। উনার রুমে, উনি আর উনার স্ত্রী বসা। তখনি বললেন, দেখো আমি চেষ্টা করেছি খোঁজ করতে। যতদূর খবর পাচ্ছি, কেউই বেঁচে নেই। এ কথাটা যখন শুনলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, আমার শরীরের সকল রক্ত যেন একেবারে হিমশীতল হয়ে গেল। তখনি মনে হয়েছিল, আমি পড়ে যাব। আমি অনেক কষ্ট করে চেয়ার ধরে নিজেকে সামলালাম। উনি, উনার ওয়াইফ মিলে আমাকে অনেক সান্ত্বনা দেন। তখন আমি আর রেহানাকে এসে কিছু বলতে পারিনি। আমি এসে দেখি রেহানা ঘুমে আছে। আমিও তার পাশে আস্তে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পরিবারের সহায়তা: তবে হুমায়ুন রশীদ সাহেবের ওয়াইফ যথেষ্ট করেছেন। আমাদের খাবার উনি গাড়িতে করে কালস্ট্রুহে পৌঁছে দিয়ে আমাদের হাতে উনি এক হাজার ডশমাক দিয়ে বললেন, তোমাদের হাতে তো অত টাকা নেই। তারপর একটা স্যুটকেস ভরে গরম কাপড় ভরে দিলেন। এগুলো তো লাগবে। কোথায় পাবা। কীভাবে কিনবা। বোধ হয় সময়ের স্নেহ আর ভালোবাসাটা বা একটা আস্থা, এটা আমাদের জন্য খুব দরকার ছিল। জামন সরকার বলল, আমরা চাইলে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম নিয়ে সেখানে থাকতে পারব। আর মিসেস গান্ধী সাথে সাথে উনার অ্যাম্বাসাডর দিয়ে আমাদের অ্যাম্বাসাডর হুমায়ুন রশীদ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। মাশাল টিটো ও তার অ্যাম্বাসাডর দিয়ে যোগাযোগ করলেন। তখন একটাই চিন্তা ছিল, আমরা দেশে যাব। দেশে যাব।

ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিকতা: মিসেস গান্ধী যেহেতু আমাদের মেসেজ পাঠালেন। সে ব্যবস্থা অনুযায়ী আমরা ইন্ডিয়াতে চলে আসি। যখন মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি, তিনি বলেন- তুমি কিছু খেয়েছ? তুমি ওমলেট খাবে? চা খাবে, টোস্ট খাবে? উনি উঠে গিয়ে সেই ওমলেট টোস্ট আর চা নিয়ে এলেন। নিজের কাপে চা ঢেলে আমাকে বললেন, খাও। তোমার মুখটা একদম শুকনো। আর তুমি কিচ্ছু খাওনি। মানে এমন ভালোবাসা, স্নেহ ঘরোয়াভাবে তিনি যেটা দেখিয়েছেন, সেটা ভোলা যায় না। সেটা আমার মনে পড়ে। সত্যি কথা বলতে কী ওই সময়ে বাবা হারানোর পর ওনার সামনে গিয়ে এই অনুভূতি হচ্ছিল- আমাদের জন্য কেউ আছে। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওনার যে অবদান।

দিল্লির অভিজ্ঞতা: প্রথম কয়েকটা বছর বসে বসে চিন্তা করে সময় যাচ্ছিল। আমি আসলে বলতে পারব না। হয়তো একভাবে বসে আছি, বসেই আছি। হয়তো এমনও সময় গেছে আমি ছেলেমেয়েদের খাবারই দেইনি। ভুলেই গেছি ওদের খাবার দিতে হবে বা রান্না করতে হবে। রান্না করে সংসার করা সেটা বলা চলে দিল্লিতে এসেই শেখা। ৮-১০ প্রকারের ডাল। সেটা আমি এখন বলতে পারছি না। মসুর ডাল, মুগ ডাল আর ছোলার ডালের বেশি চিনি না। ওদের অনেক রকমের ডাল। ধুলিডবা না ধুলির ডাল আবার কি। শিং মাছ ধরা নিয়ে কয়েকজনের দৌড়াদৌড়ি, বহু অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সারাক্ষণ উদ্বেগে থাকতাম- দেশে কী হচ্ছে। কী হবে। কারণ এ দেশটা স্বাধীন করেছিলেন আমার বাবা। দেশে গণতন্ত্র থাকবে। মানুষের কল্যাণ হবে। কিন্তু সেটা তো হলোই না। উল্টো একটা খুনিদের রাজত্ব কায়েম হয়ে গেল।

যখন দেশে ফিরলেন: আমি যখন ৮১ সালে ফিরে এলাম। তখন এ দেশে কী অবস্থা ছিল? খুনিরা তখন বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি করে। ফরেন মিনিস্ট্রিতে চাকরি করে। অবাধে বিচরণ করে। সরকার তাদের মদদ দিচ্ছে। জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। বলা যাবে না। বলতে গেলে বিএনপির গুন্ডাপান্ডারা ছুটে আসে, রীতিমতো মারতো। ছুরি দিয়ে কাটা, কোপ দিয়ে কেটে দিত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তাদের বিচার করতে দেওয়া হবে না- এটা কী ধরনের আইন। বঙ্গবন্ধুর ছবি নিষিদ্ধ। আসার পর যখন ট্যুর করতে লাগলাম- আমার তো তখন থাকার জায়গাও ছিল না। কোথায় থাকব জানি না। বাসায় ভাড়া থাকব, আমার তো কোনো সোর্স অব ইনকামও নেই। ৩২ নম্বরের বাসায় তো ওঠার প্রশ্নই আসে না। আর ওটা তখন সরকারের হাতে। আমি আসার পর যে মিলাদ পড়ব সেটাও পড়তে পারিনি। আমি রাস্তার ওপর মিলাদ পড়ে চলে আসি।

১৫ আগস্ট ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার: একজন নারী হত্যা হতেই সবাই চিৎকার করে। শিশু হত্যা হলে সবাই প্রতিবাদ করে। আর এই ৩২ নম্বরের বাসায় পনেরো আগস্ট শিশু, নারী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতিকে পর্যন্ত হত্যা করা হলো, আর সেই খুনি ঘুরে বেড়াবে, রাজনৈতিকভাবে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে না- এটা কী ধরনের আইন। সভ্য জগতে তো এ রকম আইন হতে পারে না। আমাদের বাসা সবার জন্য একেবারে উন্মুক্ত দরজা। যে কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেয়ে গেল। তারাও সারা দিনরাত আসা-যাওয়া করত, দেখত, জানত। যেমন- ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ সকাল বেলা আসত আর সন্ধ্যার পর যেত। ডালিমও আসত। নুর কামালের সঙ্গে একসঙ্গে এডিসি ছিল। যেকোনো সময় চলে আসত। এমনকি জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী। ওরাও আমাদের বাসায় আসতো, বসতো।১৯৯৬ সালে আমি প্রথম সরকার গঠন করলাম। পার্লামেন্টে আসার পর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করলাম। বাতিল করার পর আমরা আইন করলাম। অনেকে বলছেন, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বা নতুন আইন করতে। আমি বললাম, না। বাংলাদেশের ৮-১০ জন মানুষ যেভাবে বিচার পান সেই আইনেই হবে। আমি বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক। নাগরিক হিসেবে আমি সেভাবেই বিচার চাই।এত সংগ্রামের ফলে ওই (১৯৯১) নির্বাচনে হারাটা- আসলে বিশ্বাস করতেও অবাক লাগে। আমাদের পাঁচ বছর চলে গেল (২০০১), বিচারটা সম্পন্ন হলো না। ওই অবস্থায় পড়ে ছিল। খুব স্বাভাবিক, বিএনপি আসার পর ওই কেস আর চালায়নি। ২০০৯ সালে যখন আবার সরকার গঠন করি, তখন উদ্যোগ নিই।মামলাটা দিনের পর দিন চলেছে। যিনি রায় দেন গোলাম রসুল সাহেব, অত্যন্ত সাহসের সঙ্গেই রায় দেন। অবাক হবেন যে, তার তিনটি মেয়ে ছোট ছোট। কীভাবে যেন তার বাড়িতে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে ফেলল- মেয়েগুলোর যেন মানসিক কিছু একটা সমস্যা বা তার ওয়াইফকে ভীতি প্রদর্শন। এবং যেদিন বিচারের রায় হবে, সেদিন বিএনপি হরতাল ডাকল। যাতে করে জজ সাহেব কোর্টে যেতে না পারেন। রায় দিতে না পারেন, সে বাধাও কিন্তু দিয়েছিল। প্রথম রায় যখন পাই, আমি সঙ্গে সঙ্গে ৩২ নম্বরের বাড়িতে চলে গেছি। সিঁড়ির কাছে বসি। আমি সব সময় সিঁড়ির কাছে বসি। সিঁড়ির কাছ থেকেই আব্বার আত্মাটা বেরিয়ে গেছে।

আলসেখানা থেকে রাজনীতির ময়দানে: রেহানার সঙ্গে আমার মায়ের অনেক মিল। সে খুব গোছানো, নিয়মমাফিক। আমি না। আমি সব থেকে আলসে। আমার শখ ছিল গান শোনা আর বই পড়া। সারাদিন গান শুনে আর বই নিয়ে পড়ে থাকতাম। আমার ঘরের নাম ছিল ‘আলসেখানা’। আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলাম। কলেজে ভিপি নির্বাচিত হলাম, এটা ঠিক। কিন্তু যে একটা বড় দলের নেতৃত্ব দিতে হবে বা একদিন প্রধানমন্ত্রী হবো- এসব চিন্তা কোনোদিনই মাথায় ছিল না। আব্বা কিন্তু নিজের মতো করে বলতেন, এ দেশটাকে নিয়ে তিনি কীভাবে চিন্তা করেন। কী করবেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা দেশকে স্বাধীন করতে হলে যে পদক্ষেপগুলো হিসাব করে করে নেওয়া এবং সেটাকে সম্ভব করা খুব কঠিন কাজ। কেউ যদি মনে করে খুব সহজে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, এটা কিন্তু না।এলাম যখন স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্বটা তো নিতে হবে। কাজ করতে হবে। আমার যেটা লক্ষ্য ছিল, পার্টির মধ্যে অনেক দ্বিধাবিভক্তি ছিল। আমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল দলের ঐক্য বজার রাখতে। তো আমি সে অনুযায়ী চেষ্টা করে গেলাম- সংগঠনটাকে আগে গড়ে তুলি। ইডেন হোটেল যেখানে ছিল, সেখানে আমাদের সভা হতো। সেখানে প্রথম আমি একটা ঘোষণা দিয়েছিলাম- বাংলাদেশে আর আমরা রক্তক্ষয় দেখতে চাই না। সেনাবাহিনীতে আর বিধবার কান্না শুনতে চাই না। ছেলেহারা মায়ের কান্না শুনতে চাই না। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চাই। যখন আমি এ বক্তব্য দিই, অনেকেই আমাকে নিষেধ করে। কী বলেছি যে, মিলিটারি আসবে। আমাকে সত্যটা বলতে হবে। এভাবে দেশ চলতে পারে না।

স্বপ্নের টুঙ্গিপাড়া: যখন টুঙ্গিপাড়া যাই ভীষণ ভালো লাগে। খুবই ভালো লাগে। মনে হয় যেন আমি আমার মাটির কাছে ফিরে এসেছি। মানুষের কাছে চলে এসেছি। আমার তো মনে হয়- পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা টুঙ্গিপাড়া। খালের পাড়ে একটা হিজলগাছ ছিল। হিজলগাছের অনেক শিকড় হয়। ছোটবেলায় হিজলগাছের শেকড় থেকে লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপাতাম।ছোটবেলা থেকেই আমার ভয়ডর কম। গ্রামে মানুষ হয়েছি। এভাবে খোলা বাতাসে। খোলা পরিবেশে বড় হয়েছি বলেই বোধ হয় মানসিক শক্তিটা বাড়ে। গ্রাম ছাড়া ভালো লাগে না। যখন স্কুল ছুটি হতো আমরা চলে আসতাম। বিশেষ করে ডিসেম্বরে স্কুল ছুটির সময় সবাই চলে আসত। ঘরে ঘরে রান্না হচ্ছে খাওয়া হচ্ছে। সবাই একসঙ্গে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী আনন্দঘন পরিবেশে সবাই থাকত। আমি যখন রিটায়ার করব, টুঙ্গিপাড়া গিয়ে থাকব।

শেখ হাসিনা: প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা

Share.