ঢাকা অফিস: ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গতকাল র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। অভিযানের মধ্যেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন তিনি। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অধিবাসী সম্রাটের পিতা মরহুম ফয়েজ চৌধুরী রাজউকে চাকরি করতেন। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট। পরিবারের সঙ্গে প্রথমে বসবাস করতেন কাকরাইলে সার্কিট হাউস সড়কের সরকারি কোয়ার্টারে। সম্রাটের বাবা ফয়েজ উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। বাবার অনুপ্রেরণায় ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি সম্রাটের।
সম্রাটের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ ছিল সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। অবশেষে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েই তাকে গতকাল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারের পর র্যাব বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন রিমান্ডে নিয়ে একে একে অভিযোগগুলোর তদন্ত করা হবে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলে সম্রাটের প্রভাব এত বেশি ছিল যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া তাকে গ্রেফতার করতে ইতস্তত বোধ করছিল র্যাব-পুলিশ। অভিযোগ পাওয়া যায়, প্রতি রাতে রাজধানীর ১৫টি ক্যাসিনো থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে নিতেন সম্রাট। সদ্য বহিষ্কৃত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও টেন্ডার কিং জি কে শামীমের সব অবৈধ আয়ের ভাগ দিতে হতো সম্রাটকে। আবার মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধজগতের একক আধিপত্য তৈরি করে চাঁদাবাজি করতেন সম্রাট। পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাদে তার ছিল বিশাল বাহিনী। তিনি কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েক শ নেতা-কর্মী সব সময় তাকে ঘিরে রাখতেন। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিতেন শতাধিক নেতা-কর্মী। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়েই এ বাহিনী পালতেন তিনি। ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে যেতেন জুয়া খেলতে। সিঙ্গাপুরেও ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিতি ছিল সম্রাটের। সেখানে সম্রাট টাকার বস্তা নিয়ে যেতেন। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’ ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’ ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হতো বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’-এ করে।সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ভিআইপি জুয়া খেলা চলত। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর আগে প্রতিদিনই ঢাকার একাধিক বড় জুয়াড়িকে সেখানে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানো হতো। কিন্তু সম্রাটের কার্যালয়ে খেলার নিয়ম ছিল ভিন্ন। সেখান থেকে জিতে আসা যাবে না। কোনো জুয়াড়ি জিতলেও তার টাকা জোরপূর্বক রেখে দেওয়া হতো। নিপীড়নমূলক এই জুয়া খেলার পদ্ধতিকে জুয়াড়িরা বলেন ‘চুঙ্গি ফিট’। অনেকে এটাকে ‘অল ইন’ও বলেন। জুয়া জগতে ‘অল ইন’ শব্দটি খুবই পরিচিত। অল ইন মানে একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া। সংসারের ঘটিবাটি বিক্রি করে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মতোই জুয়াড়িদের অল ইন হওয়া।গতকাল গ্রেফতারের পর সম্রাটের স্ত্রী শারমিন চৌধুরীও বলেছেন, সম্রাটের নেশাই ছিল জুয়া খেলা। ক্যাসিনো-কান্ডে ইতিমধ্যে যাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তারাই সম্রাটের নাম বলেছেন। তার সহযোগী হিসেবে নাম এসেছে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কাউন্সিলর ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমানসহ আরও কয়েকজনের। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন।