ডেস্ক রিপোর্ট: সার্কের আটটি দেশের মধ্যে দুটি দেশে এখনও পর্যন্ত কোভিড–১৯ থেকে কোনো মৃত্যুর খবর নেই। আর ৩০ এপ্রিলে প্রথম বারের মতো একটি মৃত্যু ঘটলো দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে। ৮৩ বছরের একজন নারী প্রাণ দিলেন।আর এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে করোনামৃত্যু মুক্ত দেশ হলো দুই হিমালয় দুহিতা– নেপাল ও ভুটান। ভারত ও চীনের স্থল সীমান্ত দ্বারা উভয় দেশ ব্যাপকভাবে লকড থাকলেও কোভিড সংক্রমণে কারো প্রাণ প্রদীপ নিভে যায়নি।মানবজমিনের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই তিনটি দেশই গোড়া থেকেই কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলায় উপমহাদেশ এমনকি বৈশ্বিক বিচারেও যথেষ্ট ভালো ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের পরিচয় দিয়েছে। প্রায় তিন কোটি মানুষের দেশ নেপালে আক্রান্ত মাত্র ৫৭। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৬ জন। ভুটানে আক্রান্ত মাত্র ৭ জন। সুস্থ হয়ে গেছেন ৫জন। সোয়া ৫ লাখ মানুষের দেশ মালদ্বীপ। এই তিন দেশের মধ্যে মালদ্বীপে আক্রান্ত সবথেকে বেশি। সেখানেও পজিটিভ ২৮০। সুস্থ হয়েছেন ১৭। এই তিনটি দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেনি। তারা ঠেকাতে পেরেছে।
নেপাল : গত জানুয়ারিতেই প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছিল নেপালে। কিন্তু তারা টানা তিন মাসের লড়াইয়ে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। নেপালের সামরিক বাহিনী কেবল কোভিড–দানবকে রুখতেই চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ২২৫ কোটি রুপির মেডিকেল সামগ্রী তারা কিনেছে। এমনকি সমুদয় অর্থ নগদে পরিশোধ করেছে। কারণ তারা জানে বিপদের সময় অনুদান, ঋণ বা বিশেষ সম্পর্কের আশায় বসে থাকতে হয় না। চীনেরও আর্থিক সংকট থাকতে পারে। এটা লক্ষণীয় যে, ২২৫ কোটি রুপির চিকিৎসা সামগ্রীর সব তথ্য নেপাল প্রকাশ করেছে। আর ঢাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান খান ২৬ এপ্রিল বলেছেন, আমাদের কাছে এক লাখ পিপিই আছে। আরো আসছে। তাই সংকট হবে না। আবার আইইডিসিআর–এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর কতো কিট আছে, জানতে চাইলে এর আগে বলেন, সব তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।অথচ নেপাল থেকে জানা যায়, তারা নগদ টাকায় চীনের কাছ থেকে দুই লাখ পিপিই কিনেছে। যতো মেডিকেল সামগ্রী এসেছে, তার ওজন ৩৪২ টন। মোট সামগ্রী ৬৭ ধরণের । নেপালি এয়ারলাইন্সে ১৮ থেকে ২০ টন মাল ধরে। তাই তারা কিছু এনেছে চার্টার করা বিমানে। কিছু এনেছে তাতোপানি নামের শুকনো বন্দর দিয়ে। ভারতের কাছ থেকে তারা ৫৬ ধরণের ওষুধ কিনেছে, সেই তথ্যও পরিষ্কার। নেপাল লকডাউনের প্রতিকূলতার প্রকোপ কমাতে পদ্ধতিগত ব্যবস্থাও নিয়েছে। যেমন তারা এগ্রিকালচার অ্যাম্বুলেন্স চালু করেছে। কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ফসল কিনে সরকারই তা ক্রেতার কাছে বিক্রি করছে। ২৪ এপ্রিলের নেপাল টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর নেপালের ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য ১০ হাজার পিসিআর কিট দিয়েছে। শিরি এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমান সিঙ্গাপুরে উড়ে গিয়ে এই ১০ হাজার কিট বয়ে এনেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রেপিড ডায়াগনস্টিক কিট দিয়ে পরীক্ষা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। কিন্তু গত ১ এপ্রিল নেপাল টাইমসে রামু সাপকোটা লিখেছেন, নেপালি এয়ারলাইন্সের একটি বিমান গত ২৯ মার্চ চীন থেকে একটি নেপালি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ৬ লাখ ডলারের রেপিড টেস্ট আমদানির চুক্তি করে আবার বাতিল করে। কারণ নেপাল সরকার জানতে পারে যে, চীনা যেসব সংস্থার রেপিড টেস্ট কিট চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে, সেসব কোম্পানি চীনেই নিবন্ধিত কোম্পানির তালিকায় নেই। গত ৭ এপ্রিল হিমালয়ন টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়, নেপালে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। এরপর ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি পিসিআর টেস্ট করেছে। মাত্র ৯ জনকে তারা পজিটিভ পেয়েছে। তবে টেস্ট বাড়ানোর জন্য নেপাল সরকার কয়েকটি জেলায় সীমিতভাবে রেপিড টেস্ট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেপালে টেস্টের অনুপাতে শনাক্তের রেট অব্যাহতভাবে কম। ২৩ এপ্রিলেও পজিটিভ পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪৮। পরের এক সপ্তাহে এটা ৫৭তে পৌছায়।ঢাকায় একজন পর্যবেক্ষক বলেন যে, এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা, ঋণ ইত্যাদি সুবিধার কথা নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে জানা যাচ্ছে। যা প্রশংসনীয়। কিন্তু কোভিড–১৯ মোকাবেলায় শুধু মেডিকেল খাতে নির্দিষ্টভাবে কত অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেটা মিডিয়ায় নেই। কিন্তু সেটা নেপালি মিডিয়ায় আছে। যেমন নেপালের দি হিমালয়ান টাইমস ২১ এপ্রিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু কোভিড মোকাবেলায় ২৩৪ কোটি রুপি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে এবং ১১৫ কোটি রুপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে।
নেপালেও একই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশি টেস্ট বেশি সুরক্ষা। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তারা ২৯ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি সই করেছে। যার অন্যতম লক্ষ্য টেস্ট বাড়ানো। ১০ এপ্রিল কাঠমান্ডু পোস্টের একটি রিপোর্টে বলা হয়, ‘ ব্যাপকভিত্তিক টেস্ট করাতে বহু সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে অবশেষ নেপালে রেপিড টেস্ট শুরু হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক জেলায় রেপিড টেস্ট শুরু হয়। চীন থেকে আনা হয় ৭৫ হাজার রেপিড টেস্ট কিট। নেপালি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আরটিপিসিআর এবং রেপিড টেস্ট উভয়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিসিআর দিয়ে টেস্ট করালেও ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ফলস নেগেটিভ আসতে পারে। ড. সুবিদি কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেন. আরটিপিসিআর মানেই গোল্ড স্টান্ডার্ড ব্যাপার নয়। আমরা উভয় টেস্টের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেই সচেতন। তাই রেপিড টেস্ট ওবং পিসিআর উভয় মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত সঠিক।
ভুটানঃ বাংলাদেশের ৩ দিন আগে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল প্রায় আট লাখ মানুষের দেশ ভুটানে। দেশটির রপ্তানির ৭০ ভাগ ভারতে ও ২০ ভাগ বাংলাদেশে ঘটে। করোনা মোকাবেলায় আগামী ১২ থেকে ১৮ মাস লাগতে পারে। এটা ধরে নিয়েই তারা তাদের কৌশল বাস্তবায়ন করছে। দেশটি মানুষকে ঘরে রাখেত কারফিউর মতো আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছে। সবথেকে লক্ষণীয় তারা দ্রুত স্কুল–কলেজ বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।বাংলাদেশ ১৭ মার্চের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত গড়াতে দিয়েছে। কিন্তু ভুটান ৬ মার্চেই স্কুল–কলেজ বন্ধ করে দেয়। ভুটানে ডব্লিউ এইচ ও প্রতিনিধি মিজ সোনাম ইয়াঙচেন গত ১৬ এপ্রিল ভুটানের প্রশংসা করে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ভুটানি প্রধানমন্ত্রী বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিনে থাকার সময়সীমা ১৪ দিন থেকে ২১ দিনে উন্নীত করেছেন। দেশটির সকল সংসদ সদস্য এক মাসের বেতন ত্রাণ তহবিলে দিয়েছেন।
মালদ্বীপঃ ১১৬ বর্গমাইলের দ্বীপ রাষ্ট্র মলদ্বীপ। ১২ মার্চে ছিল ৮ জন রোগী ছিল। দেশটি ডব্লিউএইচও–র কাছ থেকে তিন দফায় ১১ হাজারের বেশি করোনা টেস্ট কিট পেয়েছে। আরো ১৯ হাজারের বেশি কিট তারা কিনছে। বিশেষ করে মালদ্বীপে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং লিঝং ঘোষণা দিয়েছেন যে, শতাধিক চীনা স্বাস্থ্যকর্মী মালদ্বীপের পথে রয়েছেন। গত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটি ৫৬০ মিলিয়ন মালদ্বীপের মুদ্রা খরচের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর উপলব্ধি হলো মানুষকে লকডাউন মানতে বলা আর দিনমজুর বা বেকার হয়ে পড়াদের অর্থসংস্থান নিশ্চিত না করা অর্থহীন। সেকারণে তিনি এপ্রিল, মে ও জুন মাস এই তিন মাস প্রত্যেক বেকারকে ৫ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা একটা রোল মডেল। রাজধানী থেকে ১৫ মাইল দূরে ভিল্লিভারুতে বিশাল জায়গা নিয়ে করোনা ভাইরাস কোয়ারেন্টিন রিসোর্ট করেছে।
উল্লেখ্য যে, ইতালি থেকে আসা ১৪০ যাত্রী যারা কোয়ারেন্টিনে অসুবিধার দোহাই দিয়ে মিশে গিয়েছিল। অনেকের মতে এরা টাইম বোমা হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। উল্লিখিত, তিন দেশের বাইরে সার্ক অঞ্চলে আরো বড় একটি সাফল্যের উদাহরণ শ্রীলংকা। ওই তিনটি দেশের থেকে শ্রীলংকা আয়তনে বড়। লোক সংখ্যা দুকোটির কিছু বেশি। তাদের আক্রান্ত ৬১৯। সুস্থ হয়েছেন ১৩৪। মারা গেছেন ৭ জন। আফগানিস্তানের অবস্থাও খুব উদ্বেগজনক নয়। কারণ সেখানে আক্রান্তের সংখ্যার থেকে মৃত্যুর হার তারা কমিয়ে রাখতে পেরেছে। ২১৭১ জনের মধ্যে সুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে যেখানে দেড়শর কিছু বেশি। আফগানিস্তানে সুস্থ হওয়া মানুষ ২৬০ জন। মুত্যু মাত্র ৬৪ জন। তবে সার্ক অঞ্চল থেকেও বড় সাফল্য তৈরি করেছে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আফ্রিকা এখনও প্রাথমিক অবস্থায় আছে। ৪৬ টি দেশে মৃতের সংখ্যা ৮০০–র নিচে। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ডব্লিউএইচও–র রিপোর্ট দেখা যায়, আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে ১৪ টি দেশে একটিও মৃত্যুও নেই। অথচ এসব দেশে বাংলাদেশের মতোই মার্চের প্রথম পক্ষকালের মধ্য প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল।