করোনা মোকাবেলায় দেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টদের ভূমিকা

0

ঢাকা অফিস: করোনা মোকাবেলায় দেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টদের ভূমিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) এর অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আইসিডিডিআরবি এর ভাইরোলজি ল্যাবরেটরি এর প্রাক্তন গবেষণা কর্মকর্তা সঞ্জয় মুখার্জী। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নিচে দেওয়া হলো: ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো অদৃশ্য, আণুবীক্ষণিক জীবগুলোকে অণুজীব বলা হয়। আর এদের সম্পর্কে বিস্তারিত লেখাপড়ার নাম অণুজীববিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় মাইক্রোবায়োলজি (Microbiology)। যারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে অণুজীব সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন তাদেরকে মাইক্রোবায়োলজিস্ট (Microbiologist) বলা হয়।বর্তমানে দেশে পাবলিক এবং প্রাইভেট মিলিয়ে ডজনখানেকেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারির একটি বিষয় হিসেবেই মাইক্রোবায়োলজির উপর স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান করা হয়। প্রতি বছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত গ্রাজুয়েট মাইক্রোবায়োলজিস্ট কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী নিয়ে বের হন। কিন্তু প্রশ্ন হল করোনার মহামারীর এই সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ালেখা জানা অভিজ্ঞ মাইক্রোবায়োলজিস্টরা এখন কোথায়? কি করছেন তারা?আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, শত অভাব অভিযোগের মধ্যে থেকেও আমাদের মতো দেশে মাইক্রোবায়োলজির মতো একটি অতি প্রয়োজনীয়, গবেষণাধর্মী বিষয়ে উচ্চশিক্ষা স্তরে পাঠদান চলমান রয়েছে। তবে একই সাথে এটি আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়তো এখনো এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল নন। নইলে দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে ফ্রন্টলাইনার বা অগ্রসৈনিক হিসেবে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, প্রশাসনসহ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সাথে মাইক্রোবায়োলজিস্টদেরও করোনাযোদ্ধা হিসেবে দেশের কাজে লাগানো যেত।অথচ বাস্তবতা হল এই যে, দেশে করোনা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী মহল থেকে শুরু করে, গবেষণা সেক্টর, এমনকি মাঠ পর্যায়ে করোনা শনাক্তকরণের জায়গাগুলোতেও মাইক্রোবায়োলজিস্টদের ভূমিকা চরমভাবে উপেক্ষিত। তবে আশার কথা হল, এত অবহেলা আর উপেক্ষা সত্ত্বেও দেশের এই মহাদূর্যোগে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা বসে নেই।দেশে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং দল এর নেতৃত্ব প্রদানকারী ড. সমীর সাহা এবং ড. সেঁজুতি সাহা দুজনেই খ্যাতনামা মাইক্রোবায়োলজিস্ট। দেশের বিভিন্ন ল্যাবে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে সেসব দল নেতৃত্ব দিচ্ছে সেগুলোতে রয়েছেন অভিজ্ঞ মাইক্রোবায়োলজিস্টগণ। বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েও যেই গবেষক দলটি গণস্বাস্থ্যের র‍্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের পিছনে কাজ করে যাচ্ছেন সেই গবেষক দলের ড. বিজন কুমার শীল, ড. ফিরোজ আহমেদ, ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন তারা সকলেই অভিজ্ঞ মাইক্রোবায়োলজিস্ট। যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোতেও কাজ করে যাচ্ছেন বেশ কিছু মাইক্রোবায়োলজিস্ট।অতি সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগগুলো এগিয়ে আসছে করোনাভাইরাস টেস্টের জন্য। সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে অকুতোভয় তরুণ মাইক্রোবায়োলজিস্টরা। করোনার এই যুদ্ধে এই মানুষগুলো বীরের স্বীকৃতি তো পেতেই পারেন! তবে এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কিংবা সীমিত পরিসরে নয়, বরং করোনার সাথে এই যুদ্ধে সরকারেকে সামগ্রিকভাবে দক্ষ, কার্যকর ও টেকসই সহায়তা দিতে পারেন দেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টগণ।যেমন, করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজটি সরকার চলমান রাখায় দিন দিন করোনা শনাক্তকরণের জন্য নতুন নতুন ল্যাব তৈরি হচ্ছে এবং সামনে আরো হবে। করোনাভাইরাসের মতো একটি বিপদজনক ভাইরাস নিয়ে কাজ করার জন্য নিরাপদ ও মানসম্মত গবেষণাগার এই সংকটের মুহুর্তেও খুব দ্রুত তৈরি করে ফেলা সম্ভব হলেও সেগুলোতে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল রাতারাতি তৈরি করে ফেলা সম্ভব নয়। জ্বর, সর্দির দুটো ওষুধের নাম জানলেই যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, ঠিক তেমনি দু-চারদিনের ট্রেনিং নিয়েই যে কেউ রাতারাতি মাইক্রোবায়োলজির এই সংবেদনশীল পরীক্ষাগুলোতে দক্ষ হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় মাইক্রোবায়োলজির পর্যাপ্ত জ্ঞান। পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং দক্ষতাহীন জনবল দিয়ে এই পরীক্ষা করে ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট প্রদানের পরিণাম যে কি ভয়াবহ হতে পারে তা হয়তো আমরা অনেকেই এখন অনুমান করতে পারি। তাই এক্ষেত্রে একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য কাজে লাগাতে হবে দেশের শিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত মাইক্রোবায়োলজিস্টদের।একই সাথে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধ কেবল ভাইরাস শনাক্তকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। করোনা নিয়ে উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রেও আমাদের মনযোগ দিতে হবে এখনই। আমাদের বুঝতে হবে যে করোনার মতো পরিবর্তনশীল একটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে গবেষণার কাজটি সর্বদাই চলমান রাখতে হবে। এতে করে একদিকে ভাইরাসটির পরিবর্তনের গতিবিধি যেমন নজরে রাখা যাবে, তেমনি অন্যান্য দেশের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন বা ওষুধ যদি আমাদের জন্য কার্যকর নাও হয় তথাপি নিজেরাই নিজেদের জন্য ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার করার উদ্যোগটি নেয়া সম্ভব হবে। অন্যদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধের ট্রায়ালের গিনিপিগ হয়ে আর কতদিন? তাই এই মুহুর্তে করোনাভাইরাসকে সামনে রেখেই আমাদের একটি ‘দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত গবেষণা পরিকল্পনা’ গ্রহণ করা প্রয়োজন।যেখানে দেশের বিশেষজ্ঞ অণুজীববিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে করোনাভাইরাসের গবেষণার ক্ষেত্র নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত রূপরেখা প্রণয়ন করে এ কাজে সংশ্লিষ্ট সকল সম্পদ ও সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এ রূপরেখায় আমরা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে করোভাইরাস নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি নিজেরাই নিজেদের জন্য করোনা শনাক্তকরণের কিট, ভ্যাকসিন, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করার এবং পরবর্তীতে সম্ভব হলে বিদেশে রপ্তানী করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি এ কাজগুলো করার জন্য যোগ্য ও সমর্থ্য বাংলাদেশী অণুজীববিজ্ঞানী দেশে এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। হয়তো তারা অধীর আগ্রহ নিয়ে কেবল সরকারের একটু সহায়তা কিংবা সমর্থনের আশায় দিন গুনছেন।সরকারকে এটি উপলব্ধি করতে হবে যে, এই মুহুর্তে এই ধরণের গবেষণায় অর্থ খরচ কোনো অপচয় নয় বরং এটি হবে এক ধরণের বিনিয়োগ, যার সুফল দীর্ঘমেয়াদি এবং একইসাথে এটি কেবল আমাদের দেশের জন্যেই নয়, বরং গোটা মানবজাতির জন্যেই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। সেই সাথে আমাদের আরো বুঝতে হবে যে, করোনার এই মহামারী একদিন হয়তো চলে যাবে। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র এই দেশে যক্ষ্মা, কলেরা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ডেংগু, চিকুনগুনিয়া মতো জীবাণুঘটিত রোগগুলোর পাশাপাশি এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্যোগ আগামীতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। সেই পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে চাইলে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের সাথে নিয়েই দেশের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যব্যবস্থার রূপরেখা গড়ে তুলতে হবে। অপরাপর দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে নতুন করে ঢেলে সাজাবার পরিকল্পনা করতে হবে। নিজ দেশেই গড়ে তুলতে হবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি। স্বাস্থ্যসেবাকে পৌঁছে দিতে হবে মানুষের দোরগোড়ায়। আর এজন্য দেশের সকল হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সেবা উন্নতকরণের পাশাপাশি রোগ জীবাণুগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা, রোগ প্রতিরোধে সঠিক কর্মপন্থা নিরূপণ করা, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় আগাম প্রস্তুতিসহ গবেষণাধর্মী নানা কাজকে আরও আধুনিক এবং বেগবান করতে হবে। আর এই মহাপরিকল্পনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে দেশের শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মাইক্রোবায়োলজিস্টরা।দেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টদের একাধিক সংগঠন ইতোমধ্যেই সরকারের নানা মহলে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করতে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী কমিটি থেকে শুরু করে হাসপাতাল, করোনা শনাক্তকরণের ল্যাবসহ প্রতিটি স্তরে নিজেদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে করোনার সাথে এই যুদ্ধে জয়ী শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন দেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টগণ। তবে এজন্য সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে স্থান দিতে হবে খ্যাতনামা অণুজীববিজ্ঞানীদের আর দেশে মাইক্রোবায়োলজি সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রগুলোতে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট মাইক্রোবায়োজিস্টদেরকে পদায়ন করতে হবে অচিরেই। আর তাহলেই শুধু কোভিড-১৯ এর এই মহামারীর সময়েই নয়, বরং রোগ বালাই সংক্রান্ত আগামী দিনের যে কোনো দূর্যোগকে শক্ত হাতে সামাল দেয়ার জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠবে এই দেশ।পরিশেষে, একটি তেতো ঘটনার উদাহরণ দিয়ে এই লেখাটি শেষ করা যাক। দেশে করোনা সংক্রমণের একেবারে শুরুর দিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে মানুষের মাঝে বিতরণ করতে দেখা গেছে। হালের ট্রেন্ডে সে সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগগুলোকেও এ কাজটি করতে দেখা গেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেবল এই দূর্যোগের সময়ই নয়, যে কোনো সময়ই সমাজের মানুষের জন্য কল্যাণকর হয় এমন সব কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে।কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান বিভাগগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নিজ নিজ বিষয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করা। দেশে মানবসম্পদ বানাবার কারখানা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতি সীমিত সম্পদ হাতে নিয়েও সেই কাজটি করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মহাদূর্যোগের এ সময়েও এই মানবসম্পদগুলোকে যদি যথাযথভাবে ব্যবহার কিংবা মূল্যায়ন করা না হয়, তাহলে অচিরেই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাইক্রোবায়োলজির মতো বিশেষায়িত বিভাগগুলো বন্ধ করে দিয়ে তার পরিবর্তে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কারখানা বানাবার কথা ভাবতে হবে। আমরা কেউই চাই না, দেশ সে পথে হাঁটুক।

Share.