ঢাকা অফিস: হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জাসদ নেতা সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন খান বাদল। শনিবার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা শেষে চট্টগ্রামে বোয়ালখালীর নিজ গ্রাম সারোয়াতলীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিককে। এর আগে বৃহস্পতিবার ভারতের বেঙালরুতে চিকিৎসাধীন অবস্থান শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন তিন বারের এই সংসদ সদস্য। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাতে তার মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। বাংলাদেশ সময় সকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজার পর তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। সেখানে কয়েকদফা জানাজা শেষে দাফন করা হয়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে চট্টগ্রামে বাদলের জানাজায় অংশ নেন সর্বস্তরের মানুষ। দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা সহ সকল শ্রেণী পেশার লোকজন এক কাতারে এসে সামিল হয়েছিলেন তাকে শেষ বিদায় জানাতে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে কফিন। অনেকেই দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহচর ও বন্ধুকে হাড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার টানেলে প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদলের জানাজার পর বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব এস এম শামিম উজ জামান প্রয়াত বাদলের কফিনে শ্রদ্ধা জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাদলের কফিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও মরহুমের কফিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এছাড়া ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, চিফ হুইপ নূর-ই- আলম চৌধুরী এর নেতৃত্বে হুইপবৃন্দ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষ থেকে ফখরুল ইমাম, ১৪ দলের পক্ষ থেকে মুখ্য সমন্বয়ক মো. নাসিমের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় নেতারা, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের পক্ষ থেকে শিরীন আখতারসহ দলীয় নেতারা কফিনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। জানাজায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশ নেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, হুইপ ইকবালুর রহিম, মো. আতিউর রহমান আতিক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রী মো. শাহাবুদ্দিন, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাহবুব উল আলম হানিফ, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, এ বি তাজুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, নজরুল ইসলাম বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীবৃন্দ প্রমুখ। পরে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত পরিচালিত হয়। এর আগে মরহুমের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি এবং পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর পুত্র তাইমুর নূর। এরপর মরহুমের মরদেহ চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। চট্টগ্রামে জাতীয় মসজিদ জমিয়তুল ফালায় মরহুমের দ্বিতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতি বিরাজিত থাকলেও বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের জানাযায় অংশ নেন চট্টগ্রামের বিভিন্নস্তরের মানুষ। উল্লেখ্যযোগ্য নেতৃবৃন্দ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের মঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি, আবু রেজা মোহাম্মদ নিজামউদ্দীন নদভী এমপি, মাহফুজুর রহমান মিতা এমপি, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম, সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন প্রমুখ। এরপর মরহুমের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বোয়ালখালীতে। সেখানে বাদ মাগরিব জেলা পুলিশের একটি সুসজ্জিত চৌকস দল রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার প্রদান করে। এরপর বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ মাঠে বাদ এশা অনুষ্ঠিত হয় মরহুমের তৃতীয় দফা নামাজে জানাযা। এরপর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার দিকে স্থানীয় ইব্রাহিম নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে চতুর্থ দফা নামাজে জানাযা শেষে মরহুমকে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। মঈনউদ্দীন খান বাদল বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে নিজ দল থেকে নির্বাচন করে জয়ী হন তিনি। তবে তার দল নিবন্ধিত না হওয়ায় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য হন তিনি। বাদল গত ৭ নভেম্বর ভারতের বেঙ্গালুরুতে নারায়ণ হৃদরোগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ছোট ভাই মনির জানান, দুই সপ্তাহ আগে নিয়মিত চেকআপের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন বাদল। সেখানে প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৭ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন পুত্র ও এক কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এদিকে, এরইমধ্যে তার আসনটি (চট্টগ্রাম-৮) শূন্য ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ফলে এ আসনে আগামী তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মইন উদ্দীন খান বাদল। তার বাবা আহমদ উল্লাহ খান ও মা যতুমা খাতুন। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াসে’ যুক্ত বাদল একাত্তরে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন বাদল। জাসদ হয়ে বাসদ এবং পরে আবারো জাসদে ফেরেন। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের জাতীয় কাউন্সিলে আবার দুই ভাগ হয় দলটি। হাসানুল হক ইনু ও শিরীন আখতার নেতৃত্বাধীন অংশটি ইসির স্বীকৃতি পাওয়ার পর শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান নেতৃত্বাধীন অংশটি বাংলাদেশ জাসদ নামে আলাদা দলের স্বীকৃতি চায়। তবে ইসি তাদের নিবন্ধন দেয়নি। এই অংশের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মইন উদ্দীন খান বাদল। মূলত নেতৃত্ব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ ইনুর জাসদ ছেড়ে আলাদা প্লাটফরম গড়ে তোলেন তিনি। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসন থেকে ২০০৮ সালে মহাজোটের মনোনয়ন পান শরিক দল জাসদের নেতা বাদল। নৌকা প্রতীকে তার বড় জয়ের মধ্য দিয়ে ওই আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটে। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরও দুই বার তিনি আসনের এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দৃপ্ত বক্তব্য দেয়া বাদল সমাদৃত ছিলেন একজন দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান। উগ্রসাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্টীর বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। কথা বলেছেন. সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন জনপ্রিয় এই নেতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও তার ভূমিকা ছিল।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মইন উদ্দীন খান বাদল
0
Share.