ডেস্ক রিপোর্ট: শার্লট এভান্সের বয়স যখন ১২ তখন হঠাৎ করেই তার শরীরের কোনও কোনও অংশ ফুলে যেতে শুরু করে। আর এই ফোলা ভাব থাকে মাসের পর মাস। এখন তার বয়স ১৯। এরই মধ্যে তার ফুলে যাওয়া অংশের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার ৬৬ বার অপারেশন হয়েছে। একবার এমন অবস্থা হয়েছিল যেখানে তার একটি পা কেটে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। ব্রিটেনের এই তরুণীর বলেন, ছোটকালে আমার কোনও সমস্যাই ছিল না। আমি নাচতে ভালবাসি। প্রায় প্রতিদিনই আমি নাচতাম। থিয়েটারেও নাচের অনুষ্ঠান করতাম। তারপর হঠাৎ করেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন নিতম্বে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। নিতম্বে ভেতরের এক জায়গায় বিচির মত কিছু একটা অনুভব করি। ব্যথা বাড়তে থাকলে হাসপাতালে যাই। সেখানে একসময় টের পাই আমার সব আঙুল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ডাক্তাররা এটা দেখে বলে আমার ‘কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম’ হয়েছে। এ সম্পর্কে ডাক্তাররা জানেন এবং সাধারণত শরীরে ব্যথা পেলে এটা হয়। কিন্তু আমার কেন এটা হচ্ছে সে ব্যাপারে তারা কোনও কারণ দেখাতে পারেননি। হাত এবং পায়ের মাংসপেশিগুলো বিশেষ এক জায়গায় ফ্যাসিয়া নামের একধরনের কোষ দিয়ে আটকানো থাকে। এই জায়গাগুলোকে বলে কম্পার্টমেন্ট। কোনও কারণে এই কম্পার্টমেন্টের ওপর চাপ বেড়ে গেলে ‘অ্যাকিউট কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম’ দেখা দেয়। হাসপাতালে ফ্যাসিওটমির মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়। মূলত জায়গাটিতে কেটে ফুটো করে চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, এই পর্যায়ে আমার শরীরে প্রথমবার অপারেশন করা হয়। তারা আমার মাংসপেশিতে কেটে ফুটো করে। এবং কয়েকদিন ধরে সেই ফুটো খুলে রাখা হয়। এরপর চাপ কমে গেল সেই কাটা জায়গা জুড়ে দেয়া হয়। ওই অপারেশনের পর থেকে আমার সমস্যাও বাড়তে থাকে। একবার আমাকে একটানা সাত মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। এসময় আমার মা অসাধ্যসাধন করেছেন। তিনি টানা সাত মাস হাসপাতালের চেয়ারে রাতে ঘুমিয়েছেন।হাসপাতালের শিশু বিভাগে যে সময়টুকু ছিলাম তখন মনে হতো ডাক্তাররা আমার জন্যে তেমন কিছু একটা করছেন না। এরপর তারা আমাকে বলতে থাকলেন আমার আসলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু তখনও আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা বার বার করে ফুলে উঠছিল। আমাকে দ্রুত বড় হয়ে উঠতে হচ্ছিল। আমার বয়সীদের সঙ্গে মেলামেশায় অসুবিধে হচ্ছিল। আমার অভিজ্ঞতাও ছিল কম। আমার বয়সের টিনএজাররা যা কিছু করে আমি তার কিছুই করিনি। শেষপর্যন্ত আমাকে যখন হাসপাতালে বড়দের ওয়ার্ডে সরিয়ে নেয়া হলো তখন পরিস্থিতির কিছুটা বদল ঘটলো। এর কারণ, ডাক্তাররা আমাকে নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা চালানোর সুযোগ পেলেন। এই তরুণী বলেন, স্কুলের ক্লাসে আমার উপস্থিতির হার ছিল ৪০ শতাংশ। আমার হাইস্কুল ফাইনাল পরীক্ষা আমি দিয়েছিলাম হাসপাতালের বেডে বসে। দ্বাদশ শ্রেণির প্রথম পরীক্ষাটি হয় আমার অপারেশনের ঠিক পর পর। মনে আছে, বেদনা-নাশক ওষুধ মরফিন পাম্প করতে করতে আমি ওই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এখন মনে হয় এতে আমার ভালই হয়েছিল। মরফিনের ফলে আমার পরীক্ষা নিয়ে কোনও মানসিক চাপ ছিল না, এবং সবগুলো বিষয়ে ভাল ফল করে আমি পরীক্ষায় পাস করেছিলাম।তিনি বলেন, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে আমার পা আবার ফুলে যায়। নিয়মিত চিকিৎসার জন্য আমি আবার হাসপাতালে ভর্তি হই। একদিন একজন ডাক্তার আমার বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন আমি কেমন আছি। উত্তরে আমি চাদর সরিয়ে বললাম, ‘আমার পায়ের অবস্থা এরকম। পায়ে কোন পালস্ নেই।’ দেখে ওই ডাক্তার বললেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার পায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে। তাই পাটা কেটে ফেলতে হবে। এরপর আমাকে অজ্ঞান করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম জ্ঞান ফেরার পর আমি আর পা দেখতে পাবো না। কিন্তু জ্ঞান ফিরে দেখি পা তার জায়গাতেই আছে। আমি তো খুব খুশি। ডাক্তাররা আমাকে বলল, পায়ের পালস্ ফিরে এসেছিল বলে তারা আর অ্যামপিউট করেনি। আর এক ঘণ্টা দেরি হলো পা’টা কেটেই ফেলতে হতো। শার্লট এভান্সের বলেন, প্রতিবার অপারেশনের পর আমার শরীরে কাটা দাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লোক মনে করে আমার মানসিক সমস্যা রয়েছে বলে আমি নিজেই নিজের দেহ কেটে ফেলি। কিছুদিন আগে হাসপাতালের লিফটে এক লোক আমাকে বলে আমি স্বার্থপরের মতো আচরণ করছি। করোনাভাইরাসে যখন লোকে মারা যাচ্ছে তখন আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করছি। তবে আমার প্রতি ঘৃণা আগেও দেখানো হয়েছে। আমার মানসিক সমস্যা রয়েছে মনে করে ইউনিভার্সিটিতে সহপাঠীরা আমার সাথে কথা বলতো না। এসব কথা শুনে আমারই এত খারাপ লাগে! তাহলে ভাবুন যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের কাছে কথাগুলো কত খারাপ লাগতে পারে? মানসিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা কথা বলা যে কত কঠিন তা এ থেকেই বোঝা যায়।তিনি বলেন, এবছর মোট আটবার আমার শরীরের কোনও না কোনও অংশ ফুলে গিয়েছিল। একই সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাও বাড়ছে। বয়স কম থাকলে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত। এখন সময় বেশি লাগে। এখন আমার নতুন চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এই প্রথম নতুন ওষুধে কিছু ফল হচ্ছে। ফুলে যাওয়ার ঘটনাও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। কিন্তু আমার সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা ডাক্তাররা এখনও ধরতে পারছেন না। এই ওষুধ কেন এবং কীভাবে কাজ করছে তারা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছেন না। আমি যতটুকু জানি তারা সারা দুনিয়া তন্ন তন্ন করে আমার মতো আরেকটি রোগী খুঁজে বরে করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা পাননি। তারা অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বিবেচনা করেছেন। কিন্তু সমস্যার মূল কারণ যখন জানা যায় না, তখন সঠিক চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এখন আমার সমস্যা শুরু হলে আমি বাসাতেই থাকি। তা না হলে আমাকে সারা জীবন হাসপাতালেই কাটাতে হবে। পরিস্থিতি খুব খারাপ না হলে বা অপারেশন করার প্রয়োজন না হলে হাসপাতালে যাই না। বাসায় নড়াচড়া করার ব্যাপারে মা আমাকে সাহায্য করেন।শার্লট বলেন, একটু একটু করে আমি বুঝতে পেরেছি যে দুনিয়ায় অনেক মানুষ আছে যাদের রোগের কারণ জানা যায় না। এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন। কারণ এই সমস্যার জন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে। অনেক সময় আমার সমস্যার কথা ডাক্তাররা বিশ্বাসও করতে চান না। তখন রাগ লাগলেও সেটা দমন করতে হয়, নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। সেটা না করা হলে তারা হয়তো বলবেন আমার মানসিক চাপই এই রোগের কারণ। আমার আরেকটা দু:খ নাচতে না পারা। আমি থিয়েটারে অভিনয় করতাম, গান করতাম, নাচ করতাম। এখন আবার নাচের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছি। কিন্তু ভয় আমার কাটে না। কি জানি, যদি আবার সমস্যা শুরু হয়! তাই খুব একটা ভরসা হয় না। কিন্তু তারপরও আমি আশায় বুক বেধে রাখি: হয়তো একদিন আমি সেরে উঠবো
সাত বছরে ৬৬ বার অপারেশন হয়েছে এই তরুণীর
0
Share.