বিশেষ প্রতিনিধি: শীতলপাটি, বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া একটি কারু ও লোকশিল্প। এই শিল্পের মূলধারক বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যে শৈল্পিক মন কম নয় তা শীতলপাটির মাঝেই পরিচয় মেলে। শীত মৌসুমে পুরুষরা সংগ্রহ করেন শীতলপাটি তৈরির প্রধান উপকরণ মুরতা নামের গাছ। আর সেই উপকরণকে কাজে লাগিয়ে বর্ষায় নারীরা কারুকাজে বুনেন শীতলপাটি। গরমের সময় ঘুমানোর জন্য স্বস্তি-দায়ক বলে যুগ যুগ ধরে গ্রামে কদর চলে শীতলপাটির। ইদানীং শহুরে মানুষের ঘরেও শোভা পায় শীতলপাটি। শখের বসে বিদেশেও নিয়ে যাচ্ছেন প্রবাসীদের কেউ কেউ। শীতলপাটির বুনন দেশের কয়েকটি এলাকায় কম-বেশি হয়ে থাকলেও সিলেট অঞ্চলই হলো এর জন্য প্রসিদ্ধ। সিলেট জেলার বালাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় চলে আসছে যুগ যুগ ধরে এর বুনন।বালাগঞ্জের কাশীপুর গ্রাম শীতলপাটির জন্য ইতোমধ্যে পাটিপল্লি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কাশীপুর গ্রামে এখন ১৫-২০টি পরিবার শীতলপাটি বুননের সঙ্গে জড়িত। তাদের এ পেশা চলে এসেছে বংশপরম্পরায়। একটি শীতলপাটির দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। তবে অর্ডার দিয়ে পছন্দমতো পাটি তৈরি করাতে আরও বেশি খরচ হয়। বালাগঞ্জের শীতলপাটির ঐতিহ্য কয়েক শ’ বছরের। গত কয়েক দশক আগেও উপজেলায় পাটি তৈরিতে কয়েক শ’ পরিবার জড়িত ছিল, এখন আর আগের অবস্থা নেই। নারী-পুরুষ মিলে মাত্র শতাধিক এ কাজে যুক্ত রয়েছে।বালাগঞ্জ উপজেলা সদরের থানা কমপ্লেক্সে ‘পাটিঘর’ নামের দোকানের মালিক হিমাংশু ধর জানান, নানা কারণে বুনন-শিল্পীরা উৎসাহ হারিয়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করছে নিজেদের। বালাগঞ্জ ও পাশের রাজনগর উপজেলার বুনন শিল্পীদের কারুকাজ সব সময়ই নজরকাড়া হয়ে থাকে। এখানেই সবচেয়ে দামী পাটিগুলো তৈরি হয়ে থাকে। ১ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা মূল্যের পাটি তার দোকানেই বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।সিলেটের সালুটিকর বাজারেও বসে পাটির হাট। এটি সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট এবং কোম্পানীগঞ্জ এই তিন উপজেলার মিলনস্থল। এই এলাকায় বন বিভাগের প্রচুর জমিতে মুরতার ঝোপ থাকায় পাটি তৈরি হয় কিছুটা বেশি। এই সালুটিকর হাটেই যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে শীতলপাটি কেনা-বেচা। এখানে দেখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পাশে দাঁড় করে রাখা মুরতা বেতের শীতলপাটির। সেই পাটির সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রেতারা দাম হেঁকে থাকেন আর ক্রেতারা মোড়ানো পাটি খুলে বিছিয়ে পরখ করে তবেই দরদাম করেন। বুনন শেষে টানা পুড়নের সংসারে অভাব ঘোচাতে কোনও কোনও নারী নিজেই হাটে এসে বিক্রি করেন তার শ্রমে শৈল্পিক রূপ দেয়া পাটিটি। সালুটিকরের চেঙ্গেরখাল নদী তীরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এভাবেই জমে ওঠে শীতলপাটির হাট।সালুটিকর হাটেই কথা হলো উমাইর গাঁওয়ের চান্দ আলীর সঙ্গে। ৩টি পাটি বিক্রির টাকা ক্রেতার কাছ থেকে গুনে বুঝে নিচ্ছিলেন তিনি। জানালেন, গেল বর্ষার আগে তিনি বেত সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছিলেন। পরে বর্ষায় সেই বেত কাজে লাগিয়ে স্ত্রী এবং দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে মিলে বেশ কয়েকটি পাটি বানিয়েছিলেন। অভাবে পড়লে সেখান থেকে দু-চারটে এনে হাটে বিক্রি করেন। তবে শ্রম অনুযায়ী দাম মিলছে না বলে জানান তিনি। তারপরও আগামী বর্ষায় যাতে স্ত্রী কন্যারা আরও পাটি তৈরি করতে পারেন সে জন্য এই শীত মৌসুমে অল্প অল্প করে বেত সংগ্রহের চেষ্টা করছেন তিনি।সালুটিকর ছাড়াও মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসের বাজার এলাকায় প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার শীতলপাটির হাট বসে। একই উপজেলার বাংলাবাজার, হাজীগঞ্জ, দক্ষিণভাগ, শাহবাজপুর ও রাজনগর উপজেলা এবং সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার অন্তত ৩০টি স্থানে শীতলপাটির হাট বসে। এসব হাট থেকে প্রতিবছর গড়ে অর্ধ কোটি টাকার শীতলপাটি কেনা-বেচা হয়ে থাকে বলে ধারনা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।সিলেটের উপজেলাগুলো ছাড়াও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখা, রাজনগরসহ সিলেট বিভাগের চার জেলার দু’শতাধিক গ্রামে শীতলপাটি বুননের সঙ্গে কয়েক সহস্রাধিক মানুষ যুক্ত রয়েছে। যুগ যুগ ধরেই বংশপরম্পরায় এসব গ্রামের নারী-পুরুষেরা এই কাজ করেন। সিলেটের চার জেলা ছাড়াও নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় শীতলপাটির বুনন চলে। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাটি তৈরি হলেও এ কাজে সিলেটের বুনন শিল্পীদের জুড়ি নেই। এখানে বুনন-শিল্পীরা বংশপরম্পরায় পাটির বুনন-কৌশল আয়ত্ত করতে করতে অনেকটা দক্ষ হয়ে ওঠেন।শীতলপাটি বুননের কাঁচামাল হচ্ছে মুরতা বেত। এই মুরতা গাছগুলো ঝোপের মতো হয়। নদীর তীর কিংবা খাল বা পুকুরপাড়ে এগুলো বেশি হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে গাছ পরিপক্ব হলে কেটে বেত করা হয়। কারো কারো নিজস্ব মুরতার ঝোপ থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রে সংগ্রহ করে সেই বেত পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সাধারণত বাড়ির পুরুষ সদস্যরাই এগুলো সংগ্রহ করেন। তবে বর্ষায় নারীর কোমল হাতে চলে পাটি বুনন। শীতলপাটির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গরমে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে এই পাটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত।পাটি কোমল ও মিহি করতে বেতগুলো সেদ্ধ করে নিতে হয়। এছাড়া পাটিতে নকশা ফুটিয়ে তুলতে হলে রং করতে হয়। এভাবে মাপ ও নকশাভেদে একেকটা পাটি তৈরি করতে একেকজন শিল্পীর প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন লাগে। তবে কোনও কোনও পাটি বুনতে পাঁচ থেকে ছয় মাসও সময় লাগে। শীতলপাটি তৈরির প্রক্রিয়াটি সময় ও শ্রম সাপেক্ষ। একটি ৪ হাত বাই ৫ হাত পাটি তৈরিতে কমপক্ষে ১৬০টি মুরতা বেতের প্রয়োজন পড়ে। এসব বেতের মূল্য পড়ে প্রায় ৩শ’ টাকা। এর বাইরে রং বাবদ আরও খরচ পড়ে ৩শ’ টাকা। পরিবহন খরচসহ সব মিলিয়ে একেকটি পাটি তৈরিতে যে পরিমাণ খরচ হয়, তা বিক্রি করে লাভ খুব কমই হয়।শীতলপাটির রয়েছে নানা নাম আর জাত। এর মধ্যে পয়সা, সিকি, আধুলি, টাকা, নয়নতারা, আসমান তারা, শাপলা, সোনামুড়ি, টিক্কা, আড়ুয়া নামের পাটির ব্যবহার গ্রামীণ জনপদে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া অভিজাত পাটি হিসেবে ‘লালগালিচা, ধাধুলি, মিহি নামের পাটিগুলো চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ‘সিকি’ পাটি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, মসৃণতার কারণে সিকির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না। এসবের বাইরে দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নানা ধরনের পাটি রয়েছে। বুননের মাধ্যমে পাটিতে পৌরাণিক কাহিনীচিত্র, পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক কারুকাজ তুলে ধরা হয়।
ইউনেস্কো ২০১৭ সালে স্বীকৃতি প্রদান করার পর থেকে শীতলপাটি বিশ্ব সংস্কৃতির ধারক। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বসেছিল অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় ইউনেস্কোর আন্ত-সরকার কমিটির (ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) ১২তম অধিবেশন। অধিবেশন থেকে বাংলাদেশের জন্য খুশির বার্তা আসে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর। সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় সিলেটের শীতলপাটিকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। নিবন্ধন তালিকায় বিশ্বের ১১৭টি দেশের ৪৭০টি ঐতিহ্যবাহী উপাদান জায়গা পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আরও আছে জামদানি, বাউলগান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা।