ডেস্ক রিপোর্ট: ঐতিহাসিক হেগ্রা শহরের নাম তো অনেকেই শুনেছেন। দুই হাজার বছর আগের নবতায়িয়ান সভ্যতার বিষ্ময়কর মানুষদের তৈরি এই শহর যেন পুরাতত্ত্বের খনি। খোদাইকৃত পাথরের অসাধারণ শিল্পকর্ম আর প্রাসাদের জন্য বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এই শহর এখনকার সৌদি আরবের আল-উলা উপত্যকার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু কালের সাক্ষী ওসব স্থাপনা দেখার সৌভাগ্য সবার হতো না এতদিন। সীমিত সংখ্যক মানুষকে সেখানে ভ্রমণের সুযোগ দিত সৌদি সরকার। তবে তেল রপ্তানিমুখী অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার স্বার্থে এখন পর্যটনেও জোর দিয়েছে দেশটি। আর সে লক্ষ্যেই ঐতিহাসিক এই শহরকে জীবন্ত যাদুঘরে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি যুবরাজ। এবার সৌদির বুকে লুকিয়ে থাকা অসীম রহস্য-বিষ্ময়ের ভাণ্ডার দেখার সুযোগ পাবে বহির্বিশ্ব।এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিবিড়ভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়ে আসছে সৌদি আরব। এতদিনের গবেষণায় গবেষকরা সবচেয়ে বেশি বিষ্মিত হয়েছেন আল-উলা উপত্যকার এই হেগ্রা শহরটির পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে। অঞ্চলটির নাটকীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য আর প্রাচীন ঐতিহ্য বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপনের জন্য এটিকে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক মরুদ্যানে পরিণত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সৌদি সরকার। দর্শনার্থীদের চতুর্দিক থেকে অঞ্চলটি পরিদর্শনের সুযোগ দিতে বিস্তৃত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলেছে দেশটি।এরই অংশ হিসেবে বুধবার (৭ এপ্রিল) রয়্যাল কমিশন ফর আল-উলা (আরসিইউ) এর চেয়ারম্যান হিসেবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্বলিত নির্দেশনাপত্র ‘দ্য জার্নি থ্রু টাইম’ প্রকাশ করেন। সৌদির জাতীয় ভবিষ্যতের কল্যাণে গৃহীত ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নে প্রেদন্ত সেই মাস্টার প্ল্যানে আল-উলা উপত্যকার উন্নয়নে বিস্তৃত নির্দেশনা দিয়েছেন।আল-উলা উপত্যকার এই উন্নয়নকাণ্ডের প্রধান হলেন সৌদি যুবরাজ। তার উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন যুবরাজ বদর, সৌদির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং আরসিইউ এর গভর্নর আমর আল-মাদানী। মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে, আল-উলার অকৃত্রিম, অজানা, রহস্যময় ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে উপত্যকার নিদর্শন সম্বলিত এলাকাগুলোকে এক আকর্ষণীয় মরুদ্যানে পরিণত করা হবে।পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মূল হেগ্রা অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ আল-উলা উপত্যকার বিশাল অংশকে আকর্ষণীয় নকশার জীবন্ত এক জাদুঘরে রূপ দেওয়া হবে। এর ফলে হাজার হাজার বছর আগের প্রাকৃতিক ও মানব ইতিহাসে নিমজ্জিত হতে পারবে দর্শকরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী আল-উলা উপত্যকার ৫টি শহরের আলাদা আলাদা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দর্শকদের সামনে সুচারুরূপে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে।
শহরগুলো একে অপরের সাথে জুড়ে থাকবে মনোমুগ্ধকর ছায়াঘেরা ২০ কিলোমিটারব্যাপী সবুজ মরুদ্যান দিয়ে। সেই মরুদ্যানের পথ ধরে পায়ে হেটে, বাইসাইকেলে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে এক এক শহরের রহস্যময় পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য অবলোকন করতে পারবেন দর্শনার্থীরা।আবার আল-উলা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ওই মরুদ্যানে যেতে ৪০ কিলোমিটারের পরিবেশবান্ধব ট্রামের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক হিজাজ রেলওয়ে থেকেও সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে যে পথটি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে হজযাত্রীদের দ্বারা ব্যবহার হয়ে আসছে।উপত্যকার সৌন্দর্য্যবর্ধনের কাজ শুরু হবে ওল্ড টাউন শহরটি থেকে। হেগ্রার ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি পরিত্যক্ত কাদামাটির ইটের তৈর বসতিপূর্ণ স্থান। যা কিনা এখন ভৌতিক এলাকায় পরিণত হয়েছ। এরপর প্রাচীন শহর দাদান এলাকায় শুরু হবে কাজ। তৃতীয় শহর জাবাল ইকমাহ হবে পেট্রোগিলিফ্স এর উন্মুক্ত লাইব্রেরি। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন শিলা শিল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে এখানে। এরপর নবতায়িয়ান দ্বিগলয়কে সাজানো হবে আর তারপর হেগ্রাকে দেওয়া হবে মোহনীয় রূপ।ফের আসা যাক বিষ্ময়ের শহর হেগ্রার কথায়। দুই হাজর বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত এ অঞ্চল একসময় জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে ১০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকা নবতায়িয়ান সভ্যতার দ্বিতীয় রাজধানী ছিল এ অঞ্চল। নবতায়িয়ান শাসকরা এখনকার জর্ডানের পেত্রা নগরী থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এ অঞ্চলের স্থাপত্যগুলো মেসোপটেমীয় ও গ্রীক সভ্যতা থেকে অনুপ্রাণিত। নবতায়িয়ান সভ্যতা পাথরের খোদাই করা কাজ ও স্মৃতিস্তম্ভের জন্য বিখ্যাত। এই হেগ্রাই সৌদি আরবের প্রথম ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল।তবে অঞ্চলটির প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। অনেকে হয়তো কখনো রহস্যময় ও আকর্ষণীয় নবতায়িয়ান সভ্যতার নামই শোনেনি। নবতায়িয়ানরা ছিল মূলত মরুভূমিতে বসবাসকারী যাযাবর জাতি, পরবর্তীতে তারা এ অঞ্চলে বাণিজ্য প্রসারেও ভূমিকা রাখে। সৌদি আরব ও জর্ডান হয়ে মিশর, সিরিয়া ও মেসোপটেমীয় অঞ্চলে ধূপ ও মশলা বিক্রি করতো। গোলমরিচ, আদা, চিনি ও তুলার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য গুরূত্বপূর্ণ বিভিন্ন সুগন্ধিও বিক্রি করতো তারা। ১০৬ খ্রিস্টাব্দের পর রোমানরা বর্তমান জর্ডান, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সৌদি আরবের একাংশ, ইজরাইল ও সিরিয়া দখল করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করার পর-ই ধীরে ধীরে নবতিয় সভ্যতা হারিয়ে যায়।নবতায়িয়ান সভ্যতার তেমন কোনো লিখিত দলিল না থাকায় তাদের ইতিহাস সম্পর্কেও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। বর্তমানে আমরা এই সভ্যতার ব্যাপারে যা কিছুই জানি তা প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় দলিল থেকেই। পেত্রার মতোই একসময়ের জমজমাট নগরী হেগ্রা সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত টিকে থাকা বেশিরভাগ স্থাপত্যই সমাধিক্ষেত্র। শহরটির বেশিরভাগ স্থাপত্যই সময়ের পরিক্রমায় মরুভূমির বালুর গহ্বরেই হারিয়ে গেছে। তাদের ইতিহাস অস্পষ্ট হয়ে গেলেও নবতিয় স্থাপত্যবিদ্যা ও হাইড্রোলিক প্রকৌশলে পথিকৃৎ ছিল। হাজার হাজার বছর পূর্বে তারা মরুভূমিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে জলাশয় তৈরি করতেন। সমাধিক্ষেত্রের চারপাশে পানির লাইনের মাধ্যমে সম্মুখ দরজা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, একারণেই হাজার হাজার বছর পরও টিকে আছে এই স্থাপত্যগুলো।হেগ্রায় এখনো খোদাই করা ১১১টি সমাধিস্তম্ভ টিকে আছে। নবতায়িয়ান সভ্যতার রাজধানী পেত্রায় ৬০০টির বেশি সমাধিস্তম্ভ থাকলেও, হেগ্রার স্তম্ভ গুলোই এখনো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। পর্যটকরা এই রহস্যময় সভ্যতার নিদর্শন আরও ভালোভাবে দেখতে পাবেন। স্থাপত্যে রোমান ও গ্রিক সভ্যতার অনুপ্রেরণাও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। গ্রিক, রোমান, মিশরীয় ও পারস্য সভ্যতার গুরূত্বপূর্ণ প্রতীক স্ফিংক্স ও গ্রিফিনের ভাষ্কর্যও আছে সমাধিক্ষেত্রের প্রবেশদ্বারে।স্থাপত্যগুলোর শিলালিপিতে সময়ের বর্ণনাও পাওয়া যায়। হেগ্রায় খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন সমাধিস্তম্ভ খ্রিস্টপূর্ব ১ সালের এবং সবচেয়ে নতুন স্তম্ভটি ৭০ খ্রিস্টাব্দের। তবে তারপরও এ সভ্যতার সময়কাল নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্কের অবসান হয়নি। এই সমাধিস্তম্ভের পেছনের সম্পূর্ণ গল্প এখনো অজানা রয়ে গেছে। হেগ্রার সর্ব বৃহৎ স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট, শুধু একটি পাথর খোদাই করেই এই স্তম্ভটি নির্মিত হয়। স্তম্ভটির নাম কাসর আল-ফরিদ যার অর্থ নিঃসঙ্গ প্রাসাদ। অন্যান্য স্তম্ভগুলো থেকে দূরবর্তী হওয়ায়ই এই নাম দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বাতাসে কাটা পাথরের টিলাগুলোও যেন একেকটা শিল্পকর্ম।সবশেষে বলা যায়, সৌদি যুবরাজের গৃহীত এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা গেলে বিশাল অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি বিকাশে সহায়তা করবে আল-উলা উপত্যকা। এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক মরুদ্যান পুনর্জীবন প্রকল্প। যা দর্শনার্থীদের জন্য হবে মনোমুগ্ধকর এক ভূস্বর্গ। পাশাপাশি টেকসই কৃষি উৎপাদনের জন্য একটি অনন্য সুযোগও সৃষ্টি হবে সেখানে। এরই সঙ্গে আল-উলা উপত্যকার ৮০ শতাংশ এলাকা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকবে।পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতি বছর ২০ লাখ দর্শনার্থী সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাবে যা কদিন আগেও ৬-৭ হাজারে সীমাবদ্ধ ছিল। পুরো উপত্যকাজুড়ে ৩৮ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সৌদির অর্থনীতিতে এই প্রকল্প বছরপ্রতি ৩২শ’ কোটি টাকা রাজস্বও প্রদান করতে পারবে যার ফলে মাথাপিছু আয়ও বাড়বে দেশটির।