ডেস্ক রিপোর্ট: ১৯৯৩ সালে বসনিয়া বনাম সার্বিয়া মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দেওয়ায় এর দুই বছরের মাথায় বসনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয় এবং হাজার হাজার লোক মারা যায় উল্লেখ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে গাম্বিয়া। মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ এবং এই জাতিগোষ্ঠীর লাখ লাখ সদস্যকে বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের দায়ে দেশটির বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শুনানিকালে বাদীপক্ষ গাম্বিয়া এই অনুরোধ জানায়। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে মামলাটির প্রাথমিক শুনানি চলছে। আজ বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) শুনানির শেষ দিনে বিচারকদের কাছে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে এবং দেশটিতে এখনও অবস্থান করা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাঁচাতে এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়ার অনুরোধ জানান গাম্বিয়ার কৌঁসুলিরা। রোহিঙ্গাদের পক্ষে গাম্বিয়ার নিয়োজিত কৌঁসুলি ফিলিপ স্যান্ড উনার যুক্তিতর্কে বলেন, ‘আজ সারা বিশ্ব, জাতিসংঘ এবং সবাই এই আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। রোহিঙ্গা এবং গাম্বিয়ার আশা-ভরসা এখন আপনাদের হাতে।’ গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন হয়েছে এই অভিযোগ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করে। মামলার আবেদনে তারা পাঁচটি বিষয়ে আদালতের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চায়। এগুলো হচ্ছে, দেশটিতে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে বাঁচাতে মিয়ানমারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ, সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা যাতে কোনও ধরনের গণহত্যা ঘটাতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের ওপরে গণহত্যাসহ যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে সেগুলোর চিহ্ন যাতে মিয়ানমার ধ্বংস করতে না পারে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ কামনা এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এমন কোনও নেতিবাচক কাজ না করতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দেওয়া। এর পঞ্চম বিষয়টি হচ্ছে শুনানির চার মাসের মধ্যে মামলার বাদী ও বিবাদীকে অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনে হস্তক্ষেপ কামনা। যুক্তি-তর্কের সময় বসনিয়া ও সার্বিয়া মামলার উদাহরণ টেনে কৌঁসুলি স্যান্ড বলেন, ১৯৯৩ সালে এ বিষয়ে দায়ের করা মামলায় আদালত গণহত্যা বন্ধের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দেওয়ায় এর দুই বছর পরে বসনিয়ায় সংঘটিত গণহত্যা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। স্যান্ড বলেন, গতকাল (বুধবার) মিয়ানমার পক্ষের কৌঁসুলি তাদের বক্তব্যে অনেক মামলার উদাহরণ টেনে বলেছে, গাম্বিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের কোনও বিবাদ বা সম্পর্ক নেই এবং এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি বা এই আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই আদালতের। আমি তখন চোখ বন্ধ করে শুনছিলাম এবং ভাবছিলাম তারা ১৯৬৬ সালের পশ্চিম আফ্রিকা মামলার উদাহরণ কেন বলছে না, যেখানে আদালত ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক না থাকার কারণে কোনও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়া হলো না। স্যান্ড বলেন, আমরা জানি ওই রায়টি একটি বিতর্কিত রায় ছিল, যা দীর্ঘদিন ধরে আইনি দুনিয়ায় নিন্দিত এবং আমরা আশা করি এই আদালতের বিচারকরা ওই পথে হাঁটবেন না। মিয়ানমারের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি বলেন, বিবাদী পক্ষ তার বক্তব্যে বলেছে কোনও ধরনের পদক্ষেপ অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ না দিলে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় থাকবে। কিন্তু, প্রকৃত বিষয় হচ্ছে এটি না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। স্যান্ড বলেন, প্রতিপক্ষের একজন কৌঁসুলি বলেছেন, মিয়ানমারে ১০ হাজার রোহিঙ্গা মারা গেছে এবং এটি তাদের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম হওয়ায় গণহত্যা নয়। কিন্তু, আমি বলতে চাই গণহত্যা কোনও সংখ্যার বিষয় নয়, এটি উদ্দেশ্যের বিষয়। আদালতে আমরা প্রমাণ উপস্থাপন করেছি একটি গ্রামের সব বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং গ্রামের প্রায় সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের কারণে এবং এটি থেকে বোঝা যায় মিয়ানমারের গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল। মিয়ানমারের কৌঁসুলি উইলিয়াম সাবাসের সমালোচনা করে স্যান্ড বলেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমার বাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশন নামে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাসহ হামলা চালায়। কিন্তু, ২০১৩ সালে যখন এই হামলার ঘটনা ঘটেনি তখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার সতর্কবাণী দিয়েছিলেন আইনজীবী সাবাস। এরপর গত ৬ বছরে এত ঘটনা ঘটার পর কী এমন পরিবর্তন হয়েছে যে সাবাস পক্ষ পরিবর্তন করে এখন মিয়ানমারের সাফাই গাইছেন, আদালতে জানতে চান স্যান্ড। তিনি বলেন, এই মামলায় অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) ৫৬টি দেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস সমর্থন দিয়েছে এবং আরও দেশ সামনে সমর্থন দেবে। এর মাধ্যমে মামলাটির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। আরেক কৌঁসুলি পল এস রেইলার বলেন, মিয়ানমার অভিযোগ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের জন্য, গাম্বিয়ার কোনও তাড়াহুড়া নেই, কারণ তারা মার্চে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে নভেম্বরে মামলা করেছে এবং যুক্তি দেখিয়েছে যে যদি ঘটনা এত ভয়াবহ হবে তবে তারা আগে কেন মামলা করেনি। তিনি বলেন, এর উত্তর খুব সোজা। কারণ, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের রিপোর্ট দিয়েছে, যেখানে রাখাইনের ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এবং সে কারণেই গাম্বিয়া তাড়াহুড়ো করে এই মামলা দায়ের করেছে। মিয়ানমারের আইনজীবীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তারা বলছে সেখানে গণহত্যায় নিহতদের কোনও গণকবর নেই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাঁচটি গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবর ইতোমধ্যে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। অং সান সু চির সমালোচনা করে তিনি বলেন, সু চি তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা শব্দটি আরসার পুরো অর্থ বলার জন্য দুইবার ব্যবহার করেছেন এবং রোহিঙ্গাদের নাম ধরে না ডেকে তিনি তাদের রাখাইনের মুসলিম হিসেবে অভিহিত করেছেন। আরেক কৌঁসুলি পিয়েরে দ’আজেন বলেন, মিয়ানমার গতকাল বলেছে গাম্বিয়া আরেকটি সংস্থার পক্ষে কাজ করছে। কিন্তু এটি সত্যি নয়। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে গাম্বিয়ার এই অধিকার আছে।
বসনিয়া মামলার মতো ভুল করবেন না, আদালতের কাছে অনুরোধ গাম্বিয়ার
0
Share.