ডেস্ক রিপোর্ট: এবার বিমানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও লোভনীয় প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) প্রতিস্থাপনের কাজ পেতে যাচ্ছে সেই বিতর্কিত কোম্পানি অ্যামাডিউস। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উত্থাপন করা হচ্ছে। কার্যাদেশ পেলে প্রতিবছর বিমান থেকে ১০০ কোটি টাকা আয়ের সুযোগ তৈরি হবে কোম্পানিটির। ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য কাজটি দেওয়া হতে পারে। এর আগে অ্যামাডিউসের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বিমানের ভুয়া টিকিট বুকিং দিয়ে এবং সেই বুকিং বাতিল করে এক বছরে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। আর গত ১০ বছরে কোম্পানিটি বিল বাবদ নিয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা। খোদ বিমান মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছিল এই চিত্র।সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিমানের মার্কেটিং বিভাগের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট টেকনিক্যাল টিমের সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে অ্যামাডিউসকে এককভাবে উল্লিখিত কাজটি দেওয়ায় পাঁয়তারা করছে। অনুমোদনের জন্য ফাইলটি আগামী ২৭ মে পরিচালনা পর্যদের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছে।বিমান পরিচালনা পর্যদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এর আগেও অ্যামাডিউসকে কাজটি দেওয়ার জন্য ফাইল পাঠানো হয়েছিল বিমান বোর্ডে। কিন্তু তৎকালীন বিমান পর্ষদের অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতায় সেটি অনুমোদন না দিয়ে বাতিল করে দেওয়া হয়। ওই বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে রহস্যজনক কারণে পুরো চিত্র পালটে যায়। বিমানের মার্কেটিং শাখার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দুর্নীতিবাজ কোম্পানিগুলো আবারও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। জানা যায়, বিমানের টেকনিক্যাল টিম দেশি-বিদেশি আইটি ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) পদ্ধতি প্রতিস্থাপনের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে। এরপর তারা তিনটি বিদেশি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানায়। এগুলো হলো-সর্বনিু দরদাতা হিসাবে কিউ ইনফরমেশন সিস্টেম, স্যাবার ও অ্যামাডিউস। কিন্তু সিন্ডিকেট রহস্যজনক কারণে শেষ পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত উচ্চ দরের অ্যামাডিউসকে বেছে নেয়।বিমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে জানান, তিনি কিছুদিন আগে বিমানে যোগদান করেছেন, এখনো বিষয়টি জানেন না। যদি তথ্যগুলো সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তিনি দেখবেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রথম দফায় বাতিল হওয়ার পর সিন্ডিকেট তাদের পছন্দের কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য এমনভাবে দরপত্র তৈরি করে যাতে আর কেউ কাজটি না পায়। পাশাপাশি তারা টেকনিক্যাল টিমের দক্ষ সদস্যদের কৌশলে অন্যত্র বদলি করে দেয়। এমনকি মার্কেটিং বিভাগের প্রভাবশালী সদস্যদের ‘বলাকা’ থেকে অন্যত্র সরিয়ে সেখানে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ঘটায়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-এত বড় টেন্ডারে কোনো এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হয়নি। পরিকল্পিতভাবে দরপত্রটি সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিটের (সিপিটিইউ) ওয়েবসাইটে পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যাতে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেওয়া যায়, সেজন্য পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) অনুযায়ী উদ্দেশ্যমূলকভাবে টেন্ডারের টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল প্রস্তাবের আনুপাতিক হার দরপত্র জমা দেওয়ার অনেক পরে নির্ধারণ করা হয়। বিমান থেকে শুধু পিএসএস প্রতিস্থাপনের জন্য বলা হলেও সিন্ডিকেট দরপত্রে পরিকল্পিতভাবে অনলাইন ই-কমার্স, লয়্যালিটি, জিডিএস, ট্যাপ ইত্যাদি শর্ত জুড়ে দেয় যাতে তাদের পছন্দের কোম্পানি কার্যাদেশ পায়। অথচ শতকোটি টাকা খরচ করে বিমান আলাদাভাবে অনলাইন ই-কমার্স, লয়্যালিটি, জিডিএস, ট্যাপসহ অন্যান্য ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ইতোমধ্যে তৈরি করেছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশিষ রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, পিএসএস হলো যে কোনো এয়ারলাইন্সের মূল শক্তি। বিমান বহু বছর আগে ‘সিতা’ নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে এই সিস্টেম ক্রয় করেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে বিশ্বের বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স ‘মান্ধাতার’ আমলের এই সিস্টেম বন্ধ করে দিলেও বিমান রহস্যজনক কারণে রেখে দিয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ১০ বছর আগে বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বাজারে আরও আধুনিক ও কম খরচের সিস্টেম এসে গেছে। কিন্তু লুটপাট করার জন্য বিমান এগুলো বাতিল করছে না। অ্যামাডিউসের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দূরের কথা, উলটো কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহায়তায় তারা ফুলেফেঁপে উঠছে।বিমান টেকনিক্যাল টিমের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, তারা ৩টি বিদেশি কোম্পানির সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছায় করে বোর্ডের জন্য একটি সুপারিশপত্র তৈরি করেছিলেন। ওই তালিকায় অ্যামাডিউসের নাম রয়েছে ৩ নম্বরে। তাদের দরও টেকনিক্যাল টিমের সুপারিশ করা কোম্পানির দরের ৩ গুণ বেশি। এছাড়া ১০ বছরের বেশি সময় ধরে অ্যামাডিউস বিমানের জিডিএস সিস্টেমে জড়িত থাকায় কোম্পানিটি ইতোমধ্যে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে তদন্তে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুধু অসাধু শর্ত জুড়ে দিয়ে বেশি দামে অ্যামাডিউসকে কার্যাদেশ দেওয়া হলে বিমান রিজারভেশন (পিএসএস) ও ডিস্ট্রিবিউশন (জিডিএস) থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৩ হাজার ৯৭০ ডলার হারাবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় দৈনিক হারাবে ৩৭ লাখ টাকার বেশি। আর ৫ বছরে হারাবে কমপক্ষে ৬৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে ইনস্টলেশন খরচ এক মিলিয়ন ডলার, প্রতিমাসে ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিনের খরচ ২৫০ লাখ ডলার, লয়্যালেটি প্রোগ্রাম, ডেটা মাইগ্রেশনসহ অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।এদিকে অ্যামাডিউসসহ ৪টি কোম্পানির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার টিকিট বুকিং কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এক বছরের মাথায় ফের অ্যামাডিউসকে এত বড় কাজ দেওয়ার পরিকল্পনায় খোদ বিমানজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পুরো ঘটনায় বিস্মিত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, যেই সিন্ডিকেট সেই সময় কোটি কোটি টাকার ‘আন্ডারহ্যান্ডলিং’ করে অ্যামাডিউসের সঙ্গে বুকিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাই আবার নামে-বেনামে নতুন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে।
আবার সেই বিতর্কিত অ্যামাডিউস!
0
Share.