ঢাকা অফিস: আজ পবিত্র হজ। ৯ জিলহজ (সৌদি আরবের স্থানীয় সময়) আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। এদিনের নাম ইয়াওমুল আরাফা। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক। ’ লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠের এই ধ্বনিতে আজ মুখরিত হয়ে উঠবে আরাফাত ময়দান। মহামারি করোনার পর এবারই বড় আকারে পবিত্র হজ পালিত হচ্ছে। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জমায়েত হয়েছে এবার। তাদের সমবেত কন্ঠে “লাব্বাইক” ধ্বনিতে মুখরিত হবে আরাফা ময়দান। বিঘোষিত হবে মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের কথা। কাফনের কাপড়ের মতো সাদা দু’টুকরো ইহরামের কাপড় পরে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বে আল্লাহর বান্দাহগণ। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড ইমাম হাজীদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করবেন। আল্লাহ তায়ালা এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অনন্য আবহে বিরাজ করবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্য। আজ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবেন সারা বিশ্ব থেকে জড়ো হওয়া লাখো মুসলমান। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফাতে অবস্থানই হলো হজ (মুসনাদে আহমদ ৪/৩৩৫)। পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে মিনায় মুসল্লিদের জড়ো হওয়ার মধ্য দিয়ে। শুক্রবার (স্থানীয় সময় ৮ জিলহজ) সকাল থেকে মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও বৃহস্পতিবার দুপুরে ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা শরিফ তাওয়াফের পর বিকেল থেকেই হাজিরা মক্কা থেকে আট কিলোমিটার দূরের মিনার উদ্দেশে কেউ হেঁটে, আবার কেউ গাড়িতে চড়ে মিনার উদ্দেশে রওনা দেন। অন্যান্য দেশের হাজীদের সাথে বাংলাদেশের ৮৫ হাজার হাজীও রওনা হন মিনার পথে। এ সময় গুঞ্জরিত হয় তালবিয়া-‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নালহামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা শারিকা লাক। ’ মিনায় পৌঁছে হাজীরা ফজর থেকে শুরু করে এশা অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন নিজ নিজ তাঁবুতে। মিনায় রাতে অবস্থান করে হাজীরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। আজ শনিবার হাজীরা আরাফাত ময়দানে সমবেত হবেন। তবে গতকাল রাতেই অনেকে মিনা থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হন। আরাফাতে যাওয়ার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে মুসল্লিরা হেঁটে, হুইল চেয়ারে, বাসে- যে যেভাবে পারেন পৌঁছবেন। সেখানেই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হবে। মিনা থেকে এসে হাজিরা এখানে খুতবা শোনার পর একই সাথে জোহর ও আসরের নামাজ সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করবেন। এ আরাফাতের ময়দানেই মানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এ বছর আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেয়ার জন্য মসজিদুল হারামের জনপ্রিয় ইমাম ও খতিব শায়খ ড. মাহের বিন হামাদ বিন মুয়াকল আল মুয়াইকিলিকে নিযুক্ত করেছেন সৌদি বাদশাহ। একইসাথে মসজিদে নামিরাতে নামাজ পড়াবেন তিনি। হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান সব মুসলমান পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। আরাফাতের ময়দান মক্কা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এটি দৈর্ঘ্যে দুই কিলোমিটার, প্রস্থেও দুই কিলোমিটার। এই ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। আরাফাতে রয়েছে জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড়। এই ময়দানে উপস্থিত হাজিদের উদ্দেশে খুতবা দেওয়া সুন্নত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এখানকার মসজিদে নামিরা থেকে বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। আরাফাতে অবস্থান হজের শ্রেষ্ঠ রুকন। কারণ আরাফাতের ময়দান যেন বিশ্বসম্মিলন। লাখ লাখ হাজির এ ময়দানে মুসলিমদের একতার ইঙ্গিত বহন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এই নামাজ আদায় করেছে আর এর আগে আরাফায় অবস্থান করেছে দিনে বা রাতে, তার হজ পূর্ণ হয়েছে এবং সে তার ইহরাম শেষ করেছে। ’ (সুনানে নাসায়ি) আরাফাতের ময়দান থেকে মুসলিমদের ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তির বার্তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ আরাফাতের দিন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা দেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বিন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলাম তোমাদের দ্বিন মনোনীত করলাম। ’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩) এবার বিশ্বের ৫০টি ভাষায় অনুবাদ করা হবে হজের খুতবা। বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের মানুষের কাছে হজ ও ইসলামের শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি আরব। ৫০টি ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো- বাংলা, ফরাসি, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু, হাউসা, রুশ, তুর্কি, পাঞ্জাবি, চীনা, জার্মান, সুইডিশ, ইতালিয়ান, মালায়ালাম, বসনিয়ান, ফিলিপিনো, মালয়, সোয়াহিলি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং আমহারিক ইত্যাদি। খুতবার বাংলা অনুবাদ করবেন সৌদি আরবে অধ্যয়নরত চার বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান মাক্কী, মুবিনুর রহমান ফারুক এবং নাজমুস সাকিব। তারা দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। স্মার্ট ফোন, হারামাইন শরিফাইনের ওয়েবসাইট, মানারাতে হারামাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে শোনা যাবে হজের খুতবা। ইসলামের বিধান অনুসারে, আজ সূর্যাস্তের পর হাজিরা মাগরিবের নামাজ আদায় না করেই আরাফাতের ময়দান থেকে রওনা দেবেন প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফার দিকে। সেখানে পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করবেন তারা। এখানে খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করবেন। তারপর মিনার জামারায় শয়তানকে (প্রতীকী) নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করবেন। এরপর ফজরের নামাজ শেষে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় ফিরবেন হাজিরা। মিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হাজীদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি, মাথা মু-ন করা এবং তাওয়াফে জিয়ারত। এরপর ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করে প্রতিদিন শয়তানকে তিনটি প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করবেন হাজিরা। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা। পবিত্র হজ্বের দিনে হাজিদের নির্বিঘ্নে হজ্বব্রত পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে হজ্ব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়া কর্মীদের নিয়োগ দেয়াসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জামে বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মীরা দায়িত্ব পালন করছে বলে জানিয়েছে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আজ পবিত্র হজ
0
Share.