ডেস্ক রিপোর্ট: চীনে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মের মাত্র ৩০ ঘণ্টা পর এক নবজাতকের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার খবর মুহূর্তেই দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর এটি সবচেয়ে কম বয়সে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৭শ’ ছাড়িয়েছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ৭০ হাজার অতিক্রম করেছে। মৃত ও আক্রান্তদের অধিকাংশই চীনা নাগরিক। এর বাইরে আরও ৩০টি দেশে এ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। তবে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা খুবই কম। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, শিশুরা কেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে না? প্রাদুর্ভাব সংক্রান্ত সর্বশেষ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে। সেখানে প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল উহানের জিনইনতান হাসপাতালের রোগীদের বিষয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে, ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরই বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। মাত্র ১০ শতাংশ রোগী ৩৯ বছরের কম বয়সী। গবেষকরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে এর সংক্রমণের ঘটনা বিরল। শিশুরা কেন আক্রান্ত হচ্ছে না এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে কোন সুনির্দিষ্ট জবাব নেই। এ বিষয়ে বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব রিডিং-এর ভাইরাস সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা ভাইরোলজির অধ্যাপক ইয়ান জোনস। তিনি বলেন, ‘শিশুরা হয় সংক্রমণ এড়িয়ে যাচ্ছে, নয়তো তারা মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হচ্ছে না। তবে এর কারণটি আসলে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।’ এর অর্থ হচ্ছে শিশুরা রোগটিতে খুব মৃদুভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই তারা চিকিৎসকের কাছে যায় না এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তি করারও দরকার হয় না। এ বিষয়ে সহমত জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ক্লিনিক্যাল প্রভাষক নাথালি ম্যাকডারমট। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছরের বেশি বয়সী এবং কিশোরদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশেষভাবে কাজ করে। তারা হয়তো আক্রান্ত কিন্তু তাদের সংক্রমণটা বেশ মৃদু বা তাদের মধ্যে সংক্রমণের কোনও উপসর্গ থাকে না।’ শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের এই নিম্নহার এর আগেও দেখা গেছে। ২০০৩ সালে চীনে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় ৮০০ মানুষ মারা গেলেও শিশুদের সংক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কম ছিল। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর বিশেষজ্ঞরা ১৩৫ জন শিশু আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খুঁজে পান। কিন্তু তখন ‘শিশু ও কিশোরদের মধ্যে একজনও মারা যায়নি’ বলে জানান তারা। নববর্ষের ছুটি কি শিশুদের রক্ষা করেছে? ম্যাকডারমট আরো মনে করেন যে, প্রাপ্তবয়স্করা যেভাবে ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে শিশুরা হয়তো সেভাবে ততটা সংস্পর্শে আসেনি। কারণ প্রাদুর্ভাব শুরু হয় চীনে নতুন বছরের ছুটির সময়। তখন স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। প্রায় সবগুলো প্রদেশেই স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং অনেক স্কুল পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বন্ধ থাকবে। তার ভাষায়, ‘প্রাপ্তবয়স্করা বাড়িতে যদি কেউ আক্রান্ত হয় তাহলে তাদের কাছ থেকে শিশুদের দূরে রাখে।’ তিনি মনে করেন যে, এই চিত্র পাল্টে যেতে পারে। কারণ রোগ বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং এতে করে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাইরাসের সংস্পর্শে আশার আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে। তবে সংক্রমণের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়লেও সেই হারে শিশুদের আক্রান্তের ঘটনা বাড়েনি। এখানেও সার্সের প্রাদুর্ভাবের উদাহরণ টানা যায়। সিডিসির গবেষকরা যারা শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা খতিয়ে দেখছেন তারা বলছেন যে, ১২ বছরের কম বয়সীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন কম হয়। যদিও কম সংখ্যক শিশু আক্রান্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে, তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না যে, তারা আসলে আক্রান্ত হচ্ছে না। এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ হলো, এই প্রাদুর্ভাব হয়তো সেই রোগগুলোর মধ্যে একটি যা শিশুদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের মারাত্মকভাবে সংক্রমিত করে, যেমন জলবসন্ত। বিষয়টি নিয়ে বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেছেন কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যান। তিনি বলেন, ‘শিশুদের হয়তো কোনওভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এমন ধারণার তুলনায় এটা (প্রাপ্তবয়স্কদের অধিক মাত্রায় সংক্রমিত করা) হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’ তিনি বলেন, ‘এটা এ কারণেও হতে পারে যে, কর্তৃপক্ষ হয়তো যাদের উপসর্গ নেই বা মৃদু উপসর্গ রয়েছে এমন কাউকে পরীক্ষাই করছে না।’ হংকংয়ে সার্স প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি উল্লেখ করে এ বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের স্ট্যাটিস্টিকাল এপিডেমিওলজির বিশেষজ্ঞ ক্রিসেল ডনেলি। তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মীরা যে বিষয়ে একমত হয়েছি তা হলো কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব তেমন আগ্রাসী হয় না। ফলে তারা মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হচ্ছে না।’ আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্ত যেসব প্রাপ্তবয়স্করা আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্ত তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই দুর্বল। যেমন ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্তরা এই প্রাদুর্ভাবের সময় বেশি ঝুঁকিতে থাকে। নিউমোনিয়া (করোনা ভাইরাসের উপসর্গগুলোর মধ্যে একটি) তাদেরকেই বেশি আক্রান্ত করে যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। কারণ তাদের স্বাস্থ্য এমনিতেই খারাপ কিংবা তারা হয়তো তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো পার করছে। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং শ্বাসযন্ত্রের অন্য রোগগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। জিনইনতান হাসপাতালে যেসব রোগীদের ওপর গবেষণা চালানো হয় তাদের অর্ধেকই আগে থেকেই নিরাময়যোগ্য নয় এমন অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত ছিল। সূত্র: বিবিসি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা খুবই কম!
0
Share.