ঢাকা অফিস: শিশু নির্যাতন ও হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শিশুদের সঙ্গে অন্যায় অবিচার কখনোই বরদাশত করা হবে না। যারা শিশু নির্যাতন বা শিশু হত্যা করবে, তাদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা পেতে হবে, অবশ্যই পেতে হবে। তাদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি শিশু যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, প্রতিটি শিশুর জীবন যেন অর্থবহ হয়, সরকার সেটাই চায়। শিশুদের উন্নত ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শেখ রাসেল নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। একটা ছোট অবুঝ শিশু, তার কি দোষ ছিল, সে তো রাজনীতি বুঝতো না, তাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? আর তাকে হত্যার পর ন্যায়বিচার তো দূরের কথা, বিচার রুদ্ধ করা হয়েছিল। রাসেল হত্যার পর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে শিশু হত্যার মতো ব্যাধি সমাজে ছড়িয়ে পড়তো না। অকালে হারিয়ে যাওয়া শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “সেই সময় যদি ওই শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারীদের বিচার হত তাহলে অন্তত মানুষের ভেতরে একটা ভয় থাকত। এই ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠত না।” এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে’এক ব্যক্তির নিজের শিশু সন্তানকে ‘হত্যার’ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার, অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা হয়ে সন্তানকে হত্যা করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য! কী বিকৃত মানসিকতা এদেশের মানুষের মধ্যে?” ভবিষ্যতে আর কোনো শিশু যেন হত্যার শিকার না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। শিশু হত্যাকারীদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি। বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সব ছোট ভাইকে নিয়ে আফসোস ঝরে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে। তিনি বলেন, “আজকে মাঝে মাঝে মনে হয় ৫৪ বছর পূর্ণ করেছে রাসেল। ৫৪ বছর বয়সে রাসেল কেমন হত দেখতে? আমি তার বড় বোন। আমি কোলে পিঠে করে তাকে আসলে মানুষ করেছি সব সময়। অতি আধুনিক ছিল সে, কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকে বাঁচতে দেয়নি।” ১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ধানমণ্ডির স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম নেন শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার সময় রক্ষা পাননি শিশু রাসেল। তখন তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কয়েক বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। সে সময় বাবা-মা, ভাই-ভাবীসহ স্বজনদের বিচার চাওয়ারও সুযোগ ছিল না তার। বেদনার সেই স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৮১ সালে আমি ফিরে এসেছিলাম বাংলাদেশে। আমি চেষ্টা করেছিলাম মামলা করার। আমাকে বলা হল, এই হত্যার মামলা করা যাবে না। আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার পাব না, ভাই হত্যার বিচার পাব না, আমার বাবার হত্যার বিচার পাব না। আমার প্রশ্ন ছিল, আমি কি এদেশের নাগরিক নই? সবাই যদি বিচার চাইতে পারে আমি বিচার চাইতে পারব না কেন?” সে সময় খুনিদের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি দূতাবাসে নিয়োগ দিয়ে ‘পুরস্কৃত’করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এর প্রভাবটা সমাজে পড়ে। আজকে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, শিশুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার। এই যে সমাজে এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটছে। সেই সময় যদি ওই শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারীদের বিচার হত তাহলে অন্তত মানুষের ভেতরে একটা ভয় থাকত। এই ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠত না।” এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই আর কোনো শিশু যেন এভাবে কখনো হত্যার সম্মুখীন না হয়। প্রত্যেকটা শিশু যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে আর প্রতিটি শিশুর জীবন যেন অর্থবহ হয় সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।” শিশুদের কল্যাণে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “শিশুরা যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ না করে সেই ধরনের ব্যবস্থাও নিয়েছি এবং তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে তারা লেখাপড়ার যেন সুযোগ পায়। ঝরে পড়া শিশুদের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। যারা একেবারে এতিম তাদের জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। “যারা প্রতিবন্ধী তাদের তো কোনো দোষ নেই। কাজেই আমি আজকে এখানে শিশু যারা আছে তাদের একটা কথাই বলব, তোমরা যারা ছোট এখনও তোমাদের আশপাশে যখন দেখবা কেউ প্রতিবন্ধী অথবা দরিদ্র তাদেরকে কখনও অবহেলা করো না। তাদেরকে আপন করে নিও। তাদের পাশে থেক। তাদের সহযোগিতা করো। কারণ তারাও তো তোমাদের মতনই একজন।” মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সততার সঙ্গে জীবনযাপনের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “কার একটা বড় গাড়ি আছে দেখে আমারও লাগবে, কার দামি কাপড় আছে আমারও লাগবে- এই চিন্তাটা যেন কখনো মনে না আসে।” শিশুদের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ কখনো নিজেকে ছোট মনে করবে না। এটা আমার একটা অনুরোধ থাকবে। আমি মনে করি, সব শিশুর ভেতরেই একটা সুপ্ত চেতনা রয়েছে, মনন রয়েছে, শক্তি রয়েছে এবং সেটা বিকশিত করতে হবে। তুমি নিজেকে কতটুকু পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পারো লেখাপড়া খেলাধুলা বা সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুতে কতটা নিজেকে গড়ে তুলতে পারো সেটা হচ্ছে সব থেকে বড় অলংকার, সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় শক্তি। “সততার সঙ্গে জীবনযাপন করলে সব সময় নিজের ভেতরে এমনিতেই শক্তি সঞ্চার হয়। কারও কাছে তখন মাথা নত করে চলতে হয় না।” শিশুদের পাশে থাকার লক্ষ্যেই ১৯৮৯ সালে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ গড়ে তুলেছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমি চাই এই সংগঠনের প্রতিটা ছেলে-মেয়ে নিজেদের এই কথাটা মনে রেখে তৈরি করবে। শুধু আমি নিজে পাব, নিজে করব সেটা না। কতটুকু আমার আশপাশে শিশুদেরকে দিতে পারি, কতটুকু তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। দরকার হলে নিজের খাবার ভাগ করে খাবে এটা কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করতেন “ প্রধানমন্ত্রী “আজকে রাসেল আমাদের মাঝে নেই। আমি রাসেলকে হারিয়েছি। কিন্তু এই শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মাধ্যমে আমি হাজার হাজার লাখো রাসেলকে পেয়েছি। আমার দোয়া আমার আশির্বাদ সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে।” অনুষ্ঠানে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মো. রকিবুল রহমান, মহাসচিব মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সচিব কে এম শহীদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যের আগে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শিশু-কিশোরদের হাতে প্রাপ্ত পুরস্কার তুলে দেন। এরপর দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করেন তিনি।
শিশু নির্যাতনকারীদের ছাড় নয়: প্রধানমন্ত্রী
0
Share.