অনঙ্গ বউয়ের স্মরণ : প্রথম দেখা থেকে শেষ কথা

0

বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (৮৫) আজ দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সে খবর জেনে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ সিনেমার নায়িকা বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতাকে ফোন করা হলো; অপর প্রান্ত থেকে ববিতা শুধু জানালেন, ১০ মিনিট পর কথা বলবেন। মিনিট দশেক পর ফোন করে ববিতাকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার খবর জানানো হলে মলিন কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘এই খবরটা একটু আগে পেয়েছি এবং আমি সাংঘাতিক মর্মাহত। কারণ, বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ছবির অভিভাবক, বিরাট বটবৃক্ষ, যার তলায় বর্তমানে বাংলা ছবি বিরাজ করছে। একটি মাস ধরে তাঁর অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, আশঙ্কিত সমগ্র বাংলা ছবির জগৎ। যা-ই হোক, শেষমেষ মনে অনেক দোয়া-প্রার্থনা করেছি, সৌমিত্র বাবু যেন ফিরে আসেন। কিন্তু শেষমেষ আমরা আর পেলাম না…।’

প্রথম দেখা ও শুটিং: সৌমিত্র বাবু একজন অসাধারণ মানুষ। উনি এত বড় একজন শিল্পী যে আমি বলে বোঝাতে পারব না। আর আমি যখন কাজ করেছি, ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সিনেমায় কাজ করতে গেলাম, তখনই দাদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন আমার বয়সটাও কম ছিল, ১৫-১৬ বছর। ঢাকায় মনে হয় একটি-দুটি ছবি করেছি। আমি খুব যে চলচ্চিত্রের সবাইকে চিনি তা বলব না, খালি আমি ‘অপুর সংসার’ ছবিটা বোধহয় দেখেছিলাম। আর খুব একটা আমি নিজেও জানতাম না। যখন কাজ করতে গিয়েছি, প্রথম দেখা হয়েছে বীরভূম-শান্তিনিকেতনের একটি আউটডোর লোকেশনে, সেখানে উনার পোশাক-আশাক গেটআপ দেখে আমি অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর উনি খুব আদর করে কাছে ডেকে বললেন, ‘তুমি জানো, আমি যে গঙ্গাচরণ আর তুমি হচ্ছ গিয়ে অনঙ্গ বউ।’ আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। তারপর উনার এই যে সুন্দর-সুন্দর ব্যবহার… এবং সবচেয়ে আমি নার্ভাস হয়েছিলাম বিদেশি আর্টিস্ট, আমি কাজ করতে পারব কি পারব না। কিন্তু দেখলাম, উনি এত আপন করে নিয়েছেন, মোটেও আমার খারাপ লাগেনি। একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লেগেছে, আমি যখনই ক্যামেরার সামনে শট দিচ্ছিলাম, তখনই সৌমিত্রকে দেখেছি ওই ক্যামেরার পাশে মানিক দাদা ক্যামেরার লুক থ্রো করছে, লুক নিচ্ছে; উনি দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। দাঁড়িয়ে থেকে কেমন অভিনয় করছি না করছি, সেটা দেখছেন…

শুটিংয়ের বাইরে সৌমিত্র: কাজ করতে করতে আমাদের এত মিষ্টি সম্পর্ক হয়েছিল, শুটিংয়ের ফাঁকে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। আমি দেখেছি দাদাকে, শুটিংয়ের ফাঁকে তিনি কবিতা আবৃত্তি করছেন, শরীরচর্চা করছেন। আমরা হয়তো শুটিং শেষ করে কলকাতায় ফিরছি, সেই ট্রেনে বসে আমরা গেম খেলেছি। তারপর যখন জার্মানির বার্লিন ফেস্টিভ্যালে আমরা গোল্ড পেলাম, সেদিন যে কী অবস্থা; সেদিন সৌমিত্র দাদার মুখের অদ্ভুত যে খুশি, সেটা আমি আগে দেখিনি।

শেষ দেখা: সৌমিত্র দাদা প্রায়ই আসতেন ঢাকায়। তিন-চার বছর আগে একটা আয়োজন হলো, সৌমিত্র দাদা আছেন… ববিতাও আসুক…। সেখানে দাদাকে দেখে আমি একদম দরজা দিয়ে ঢুকে ‘দাদা, আপনাকে এত দিন পর দেখছি’ বলে দৌড় দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। সে কী যে একটা ফিলিংস, আমি বলে বোঝাতে পারব না। আর এমনিতে কলকাতায় যখন গিয়েছি, ফোনে কথা হয়েছে।

সবশেষ কথা: দাদা আমাকে বলেছিলেন, “এই তো তুমি কেমন আছ? তুমি শুনলাম অনেক ছবিটবি করেছ, অনেক বিখ্যাত হয়েছ, অনেক পুরস্কার জিতেছ। আমরা জানতাম, তুমি যখন ‘অশনি সংকেত’ করেছ, তখন আমরা বুঝতে পেরেছি, তুমি একদিন অনেক বড় হবে।”

ফোন রাখার আগে ববিতা বললেন, ‘দাদা আমাকে নিয়ে অনেক ইন্টারভিউতে ভালো ভালো কথা বলতেন। উনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন চিরকাল। উনি এত বড় একজন শিল্পী, আমি মেনেই নিতে পারছি না… তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি…।’১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘অশনি সংকেত’। অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এই সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা। অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সন্ধ্যা রায়, চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম রঙিন সিনেমা।

Share.