আজ বাংলাদেশকে ব্রিটেনের তাৎপর্যপূর্ণ স্বীকৃতির ৫০ বছর পূর্তি

0

ডেস্ক রিপোর্ট: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন রাজধানী হিসেবে ঢাকার অভ্যুদয় ঘটার পরপরই তৎকালীন শীতলযুদ্ধ যুগের মেরুকরণকৃত উভয় পক্ষের মধ্যেই দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার তোড়জোর শুরু হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দিকেই বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতিদানকারীদের মধ্যে লন্ডন অন্যতম। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জোটভুক্ত দেশগুলোর কাছে থেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ করার মুহূর্তেই ব্রিটিশ স্বীকৃতিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সিদ্ধান্তটি তৎকালীন বিশ্ব-রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার কারণ ছিল এই যে, স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারকে সমসাময়িক ব্রিটিশ কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারকরা জোটনিরপেক্ষ হিসেবেই জানতেন। ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশকে তখন কৌশলগতভাবে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন মস্কোর বিরুদ্ধে চীনের সাথে এক গোপন সম্পৃক্ততার আওতায় অনেকাংশেই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে ঢাকা জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে বাসস এর কূটনৈতিক প্রতিনিধি তানজিম আনোয়ারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মনে করি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার কারণে যুক্তরাজ্য (বাংলাদেশকে স্বীকৃতি) এ ভূমিকা পালন করে।’ ডিকসন স্মরণ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিটেনে রাজনৈতিক ও জনগণের অত্যন্ত জোরালো সমর্থন ছিল। ‘মুক্ত নেতা হিসেবে লন্ডনে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসী প্রথম পদক্ষেপ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাজ্যেকে প্রভাবিত করেছিল। পাকিস্তানি কারাগারে কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে প্রথমেই নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে লন্ডনে যান। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন সত্ত্বেও ঢাকা প্রধান শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিল। যদিও মস্কোর সহায়তার কারণে মনে করা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশ মস্কোর পক্ষাবলম্বন করবে। ড. কামাল তার ‘বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ বইয়ে লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধু ভারসাম্য রক্ষার জন্য অঞ্চলের বাইরে সেখানে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন পৌঁছান। সেখানে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি সেখানে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। আর তার পরেই তিনি ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স কমেট জেট বিমানে করে দিল্লী হয়ে তাঁর প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ঢাকায় নিযুক্ত বর্তমান ব্রিটিশ দূত ডিকসন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে হিথের সঙ্গে নতুন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকটিকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ও বক্তব্য ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। হাই কমিশনার বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাজ্যের অংশীদারিত্বের এই সূচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয়। তাই এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে আমরা একটি অত্যন্ত জোরালো ভিত্তি পেয়েছিলাম।’ ডিকসন বলেন, ওই সময় এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের শেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং ভারতীয় সেনারা দ্রুত বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে। ‘এটা স্পষ্ট ছিল যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এবং এ জন্যই একটি স্বাধীন দেশের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বালাদেশের সঙ্গে কাজ করার জন্য তখন বাংলাদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দেয়ার সঠিক সময় ছিল।’ তিনি বলেন, তখন থেকে ব্রিটেন বাংলাদেশের একটি দৃঢ় সমর্থক হিসেবে রয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের সাথে একটি অত্যন্ত দৃঢ় রাজনৈতিক ও উন্নয়ন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে অত্যন্ত জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান আছে।’ হাই কমিশনার বলেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিগত ৫০ বছরে একটি ব্যাপকতর বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। তিনি ২০২২ সালকে উভয় দেশের জন্য একটি বিশেষ বছর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘মহামারি পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঢাকায় তাঁর মিশন এই সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটাতে চায়।’ ব্রিটিশ দূত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশেষত গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত গত কপ ২৬ সম্মেলনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, গোটা বিশ্বকে বাংলাদেশের কাছ থেকে জলবায়ু অভিজোযন সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার আছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে ব্রিটিশ দূত বলেন, বাংলাদেশী জনগণের সহনশীলতা, সৃজনশীলতা, গ্রহণ করার ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য দেশটিকে ১৯৭১ সালের অত্যন্ত প্রতিকূল ও কঠিন অবস্থা থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রান্তে নিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য-নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে ব্রিটেন ২০২৬ সালের পরবর্তী অন্তত তিন বছর দেশটির বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশের জন্য শুল্কমুক্ত কোটা অব্যাহত রাখবে। ডিকসন আরও আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, সম্মানের সাথে ও স্বেচ্ছায় রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসন সহ রোহিঙ্গা সংকটের একটি সমাধান হবে। তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাজ্য এ ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

Share.