এরশাদ শিকদারের বিলাসবহুল সেই ‘স্বর্ণকমল’ভেঙে ফেলা হচ্ছে

0

বাংলাদেশ থেকে খুলনা প্রতিনিধি: খুলনার কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের ‘স্বর্ণকমল’ নামের বিলাসবহুল সেই বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। জমির মালিকরা সেখানে বহুতল ভবন করবেন। এ কারণেই গত কয়েকদিন ধরে ভব্নটি ভাঙার কাজ চলছে। এই ভবনে বসেই এক সময় এরশাদ শিকদার গেয়েছিলেন, আমি তো মরে যাবো, রেখে যাবো স্মৃতি/ আছিসনি কেউ সঙ্গী-সাথি/ সঙ্গে আমার যাবি। ভবন ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক আজিজুল, রহমানসহ অন্যরা জানান, স্বর্ণকমলের অর্ধেক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অর্থের প্রয়োজনে বড় স্ত্রী খোদেজা বেগম ও তার সন্তানরা আলোচিত স্বর্ণকমলসহ ৫ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যেখানে বহুতল বিশিষ্ট ভবন তৈরি করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর সোনাডাঙ্গা থানা এলাকার মজিদ সরণিতে আলোচিত এই বাড়িটি নির্মাণের জন্য সেসময় বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল সবধরনের সামগ্রী। নকশা হেরফের হওয়ার কারণে জীবন দিতে হয়েছিল রাজমিস্ত্রির। আলোচিত ও দর্শনীয় ভবনটি ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়লে কৌতুহলী মানুষ ভবনের সামনে ভিড় করে। ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে এরশাদ শিকদার অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তার প্রিয় ‘স্বর্ণকমল’ ঘিরে তৈরি হয় নানা রহস্য। প্রায় দুই দশক পরও দূর-দূরান্ত সেখানে সেখানে ছুটে আসতো মানুষ। এটি ছিল এরশাদ শিকদারের বাসভবন। এই ভবণ নির্মাণ, স্থাপত্যশৈলী, ভবন অভ্যন্তরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও ছিল আলোচনা। এবার হয়তো সেই অধ্যায়ের যবনিকা ঘটবে। ভাঙা পড়ছে রহস্য ঘেরা স্বর্ণকমল। বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল’ এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী। বাড়িটিতে গোপন কুঠরি এবং অস্ত্র ভান্ডারের কথাও শোনা যায়। শোনা যায়, ওই বাড়ির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসতো বাড়িতে। শহরের নামিদামি ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এক সময় সাধারণ মানুষের খুব আগ্রহের জায়গা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই বাড়িটি। বিশেষ করে ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করার পর জৌলুশ হারানো বাড়িটি ছিল রহস্যে ঘেরা। ভনবটির প্রবেশদ্বারে সোনালি প্লেটের ওপর লেখা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। কথিত আছে, বাড়িটি বানানোর সময় এরশাদ শিকদারের হাতে খুন হন রাজমিস্ত্রি। বাড়ি নির্মাণের গোপন বিষয়গুলো যেন কেউ জানতে না পারেন সেজন্য তাকে হত্যা করা হয়। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, এ বাড়ি নির্মাণের সময় কিছু অংশ অন্যের জমিতে ঢুকে যাওয়ায় রাজমিস্ত্রিকে খুন করেন এরশাদ শিকদার। এরশাদ শিকদার যখন জীবিত ছিলেন তখন অবৈধ উপায়ে শত কোটি টাকা অর্জন করেছিলেন। বাড়িটিতে বসতো জলসা। সেই জলসায় অংশ নিতেন খুলনার রথি-মহারথিরা। এরশাদ শিকদারের মৃত্যুর পরও কিছুদিন নামফলকটি থাকলেও পরে তা খুলে ফেলা হয়। এরপর আর কোনো নাম দেওয়া হয়নি ভবনটির। কিন্তু সম্প্রতি ভবনের একাংশ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এরশাদ শিকদারের ছেলেরা। সেই সিদ্ধান্তের পর বাড়িটির ভেতরে ভাঙার কাজ শুরু হয়। অবশ্য এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি বাড়িতে অবস্থান নেওয়া স্বজনরা। এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবা ছিলেন বন্দে আলী শিকদার। ৮ ভাইবোনের মধ্যে এরশাদ শিকদার ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সালে জন্মস্থান নলছিটি ছেড়ে খুলনায় চলে যান। ঘাঁটি গাড়েন ৫ নম্বর ঘাট এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই এরশাদ শিকদার ছিলেন দুরন্ত সাহসী। ১২ বছর বয়সেই ৭০-৮০ কেজি বস্তার চাল ও গম নিয়ে কার্গো থেকে লাফিয়ে ভৈরব নদ পেরিয়ে যেতেন অনায়াসে। ফলে তার নাম হয়ে যায় ‘রাঙ্গা চোরা’। একপর্যায়ে খুলনা রেলস্টেশনে নেন কুলিগিরির কাজ। এরপরই জড়িয়ে পড়েন নানা দুর্নীতির কাজে। সেই সময়ে যারা তার সঙ্গে ছিলেন তাদের নিয়ে গঠন করেন একাধিক দল। এর মধ্যে ছিল শিক্ষিত আর অশিক্ষিত বাহিনী। একটি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল জামাই ফারুকের হাতে। অপর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল লিয়াকত লষ্করের হাতে। আর তার নিজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন নুরে আলম। মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে এরশাদ শিকদার ‘রামদা বাহিনী’ নামে একটি দল গঠন করেন। যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এই রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ শিকদার ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচন করেন এরশাদ শিকদার। জয়ী হন বিপুল ভোটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘাট এলাকায় এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা করেননি কুখ্যাত এই খুনি। খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, নারী অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এরশাদ শিকদার। ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন তার বডিগার্ড নুরে আলম। ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনার জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এরশাদ শিকদারের। কোথায় আছেন পরিবারের সদস্যরা এরশাদের দুই স্ত্রী খোদেজা বেগম ও সানজিদা নাহার শোভা। এরশাদ শিকদারের তিন ছেলে রয়েছে। তারা হলেন- মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, কামাল শিকদার ও হেলাল শিকদার। তারা পেশায় ব্যবসায়ী। এছাড়া সুবর্না ইয়াসমিন স্বাদ ও জান্নাতুল নওরিন এশা নামে এরশাদ শিকদারের দুই মেয়ে ছিল। যার মধ্যে এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করেন। এরশাদ শিকদারের মেজ ছেলে মো. কামাল শিকদার নিজের বাবাকে একজন আদর্শ বাবা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘প্রত্যেক বাবাই তার সন্তানের কাছে আদর্শ। বাবার পরিচয়েই আমরা চলছি। কোথাও বাবার পরিচয় লুকাতে হয় না। আমার বাবা ব্যক্তিগত জীবনে কী করেছেন- সেটি তার পার্সোনাল ব্যাপার। আমার বাবা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।’ তিনি আরও বলেন, বাবার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে স্যারেন্ডার করেছিলেন। আশা করেছিলেন, আইনের সুযোগ পাবেন। পাননি। রাজনীতিই বাবাকে ওপরে উঠিয়েছে, রাজনীতিই তাকে শেষ করেছে।

Share.