গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম, ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে শতাধিক ঘর

0

বাংলাদেশ থেকে গাজীপুর প্রতিনিধি: মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে গাজীপুরে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরীর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে সম্পূর্ণ তৈরীর আগেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে শতাধিক ঘর। ওই ঘরগুলোতে সিমেন্ট বালি, রড, ইট, খোয়া থেকে শুরু করে দরজা জানালায় ব্যবহার করা সামগ্রী গুলোও অত্যান্ত নিন্মমানের ছিল বলে জানাগেছে। গাজীপুর সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের একটি ওয়ার্ডে সম্প্রতি শতাধিক ঘর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ভেঙ্গে ফেলা ঘরগুলো নতুন করে মানসম্মত উপকরণ দিয়ে তৈরী করার কথা বলেছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম সাদিক তানভীর। জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হয় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার জন্য এ ঘরগুলো তৈরীতে কোন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদারকিতে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। খাসজমিতে তৈরি করা ঘরগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ‘ক’ শ্রেণীভূক্ত এ বাড়ি গুলো দৃষ্টিনন্দন রঙিন টিনের দুই কামরার সেমিপাকা বাড়ি নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি ঘরের আয়তন হবে দৈর্ঘ্যে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি আর প্রস্থে ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। রান্নাঘর ও শৌচাগার থাকবে। প্রতি ১০ ঘরের জন্য একটি নলকূপ। সব মিলিয়ে বাড়িপ্রতি খরচ ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। ইটের সংখ্যা, সিমেন্ট ও বালুর পরিমাণও বলে দেওয়া হয় নকশা মোতাবেক। নির্দেশিকা অনুসারে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর সঙ্গে কোন মিল দেখা যায় নাই। প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি থাকলে কমিটির সদস্যদের সাথে এ নিয়ে কোন সমন্বয় করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া, পিরুজালী ও ভাওয়াল মির্জাপুর ইউনিয়ন এবং সিটি কর্পোরেশনের ৩নং ওয়ার্ডে তিনটি স্থানে নতুন নির্মিত ঘরগুলো নিন্মমানের উপকরণ ও সঠিক মালামাল দিয়ে তৈরী না হওয়ায় সম্প্রতি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওই ঘরগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, গাজীপুর সদর উপজেলায় ১৬০টি ঘর নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। নতুন আরো ৩০০ ঘর নির্মাণের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে। শিগগিরই এসব ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। গাজীপুর সদর উপজেলা এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন স্থান ঘুরে নির্মানাধীন ঘর সমূহের নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। নিন্মমানের ঘর তৈরীর দৃশ্য দেখে স্থানীয়রাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। পিরুজালী এলাকার অনেক বাসিন্দারা জানান, সবার চোখের সামনে অনিয়মে ভরপুর ঘরগুলো তৈরী করা হলেও এ কাজ গুলো দেখার কেউ নেই। ঘরগুলোর কাজ প্রায় ২৫ থেকে ৫০ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘরগুলো ভেঙ্গে দেন। স্থানীয়রা বলেন, সঠিক তদারকির অভাবে নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী এবং পরিমাণের তুলনায় কম নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ঘর গুলো তৈরী করা হচ্ছিল। নির্মাণাধীন ঘর সমূহের মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তরপাশে ৬টি, খুন্দিয়া এলাকায় ৯টি, ভাওয়াল মির্জাপুর নয়াপাড়া খালপাড় এলাকায় ১৫টি, পিরুজালী পাতিলবান্দা এলাকায় ৬০টি, মহানগরীর ৩নং ওয়ার্ডে কাশিমপুর গোবিন্দপুর এলাকায় ১৭টি, একই ওয়ার্ডে হাতিমারা কলেজের পাশে ৮টি, ২৩নং ওয়ার্ডে হাতিয়াবো এলাকায় ১৪টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর প্রায় সব গুলো ঘর গত তিন দিনে ভেঙ্গে ফেলা হয়। এর মধ্যে কিছু ঘর পুরোপুরি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে আবার কিছু ঘর ২৫ থেকে ৫০ভাগ কাজ সম্পন্ন অবস্থায় ছিল। সরেজমিনে ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে শাবল, হাতুড়ির মাধ্যমে ঘরগুলো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে যে ভিম ঢালাই দেওয়া হয় এর মধ্যে একটি করে রড ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোনটিতে ভিমের মধ্যে কোন রড দেওয়া হয়নি। ঢালাই দেওয়া ভিমগুলোতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথেই বালির মতো ভেঙ্গে পড়ছে। নির্মাণাধীন দেওয়াল গুলো বাঁশ দিয়ে ধাক্কা দিতেই ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। কলামের মধ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে দুটি চিকন রড, তৈরী করা পরের মেঝে ফেটে গেছে। সামান্য আঘাতে গর্ত হয়ে যাচ্ছে পাকা ফ্লোর। দুর্বল পাতলা প্লেনসিট দিয়ে তৈরী করা হয়েছে দরজা-জানালা। স্থানীয়রা আরো জানায়, নামমাত্র মাটি খুঁড়ে তৈরী করা হচ্ছিল ভূমিহীনদের ঘর গুলো। নির্মাণ কাজ চলার সময় আশপাশের কোন লোককে প্রকল্পের ধারে কাছে আসতে দিতো না নির্মাণকারীরা। বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণে নামমাত্র সিমেন্ট দেওয়া হতো। ঢালাই কাজে ব্যবহার করা হয় নিন্মমানের খোয়া এবং বালু। ঘরের ভিমে যেখানে চারটি রড দেওয়ার কথা সেখানে দেওয়া হয় একটি মাত্র রড। আবার কোনটিতে রড দেওয়াই হাতো না। আবার যেসব পিলার তৈরী হয় তাতে দেওয়া হয়েছে মাত্র দুটি করে চিকন রড। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে তাদের মামলার হুমকি দেওয়া হতো। এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে ভিমে চারটি রড দেওয়া হয়েছে। পরে চলে আসার পর জানতে পারি ওই রড উঠিয়ে সেখানে একটি রড দিয়ে ঢালাই দেওয়া হয়েছে। পরে নানা প্রকার অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে দেখে ঘরগুলো মান সম্মতাভাবে নির্মাণ হচ্ছে না মনে করে তা ভেঙে ফেলার নিদের্শ দেওয়া হয়। স্থানীরা জানায়, এসব ঘর তৈরীকালে সরকারী কোন কর্মকর্তা বা দায়িত্বশীল কাউকে দেখা যায়নি। ঘরগুলো স্থানীয় লোক দিয়েও করা হয়নি। এ প্রকল্পে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি কমিটি রয়েছে যার সদস্য হলেন উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা, এসি ল্যান্ড ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এ প্রকল্পের কাজ চলার সময় দায়িত্বশীল কোন লোকের তদারকি না থাকায় নিন্মমানের উপকরণ দিয়ে তৈরী করা হচ্ছিল ঘর গুলো। যা নির্মাণ হতে না হতেই ভেঙ্গে পড়তে বসেছিল। নির্মাণ কাজে যুক্ত এক নির্মাণ শ্রমিক আলী হেসেন বলেন আমাদের যে মালামাল দিয়ে কাজ করতে বলা হয় আমরা তা দিয়েই কাজ করি। ভাল মন্দ তাদের ব্যাপার। আমরা নিজেরাও জানি কাজটি খুব খারাপ হচ্ছে তারপরও আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা রোজ হিসেবে টাকা পাই আর কাজ করি। এ ব্যাপারে মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুসল্লি বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর তৈরী হয়ে গেলে আমাদের কাছ থেকে গৃহহীনদের নাম নেওয়া হয়। এছাড়া এ প্রকল্পের কোন কাজের সঙ্গে আমাদের ডাকা হয়না এবং জানানোও হয়না। সমস্ত কাজই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা করে থাকেন। আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজের ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভভ হয়নি।

Share.