ঢাকা অফিস: ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক কলহ, প্রতিশোধ ও অর্থ লেনদেনসহ বেশ কিছু কারণে সংঘটিত সাইবার অপরাধ বেশি হচ্ছে। আর এসব অপরাধের বেশিরভাগেরই ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বক্তিগত সম্পর্কের কারণে অনলাইনে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী মেয়েরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর ৩০ বছরের ওপরে আর্থিকভাবে সাবলম্বী নারীদের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনকে ঘিরে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে তারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে হরহামেশাই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনেক সময় হেনস্তা থেকে তা চলে যাচ্ছে নারীর নিরাপত্তাহীনতার পর্যায়ে। এতে করে পাল্টে যাচ্ছে নারীর জীবন। এমনকি মানসিক পীড়ন সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত গড়াচ্ছে। নবম শ্রেণী পড়ুয়া ভুক্তভোগী প্রিয়ন্তী (ছদ্মনাম) তার বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ঢাকা টাইমসকে। বলেন, ‘ফেসবুকের মাধ্যমে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয় আমার। এক পর্যায়ে কিছু ব্যক্তিগত ছবি আদান প্রদান হয় আমাদের। তখন আমি বুঝতে পারিনি পরে এই ছবিই আমার কাল হবে।’ প্রিয়ন্তী বলছে, একসময় তিক্ততার কারণে সেই ছেলেটির সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়। সমস্যার শুরুটা ঠিক তখন থেকেই। ছেলেটি প্রিয়ন্তীর সেইসব ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলে। ছবিগুলো পোস্টের পাশাপাশি ওই আইডি থেকে ব্যক্তিগত ছবি তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের পাঠাতে থাকে। প্রিয়ন্তী বলেন, ‘অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে আমার মা-বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মানসকিভাবে ভেঙে পড়ি। আমার মনে হতো আত্মহত্যাই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। পরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পুলিশ ওই ছেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর এখন আমি ভালো আছি।’ নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিত করতে ২০২০ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ পুলিশের সেবা ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের ওই ফেসবুক পেইজে ২০ হাজার ৬৭৫টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৩৭ হাজার ১৮৯টি ফোনকল ও ৫০৮ টি মেইলে অভিযোগ জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। কলেজ শিক্ষার্থী আমেনা (ছদ্মনাম) ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি হ্যাক করে এক ব্যক্তি সেখান থেকে ছবি সংগ্রহ করে। পরে আপত্তিকরভাবে এডিট করে আইডিতে পোস্ট দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও দেয় ছবির সঙ্গে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও বাড়তে থাকে কয়েকগুণ। পরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন শাখার সহযোগিতায় জানতে পারি অভিযুক্ত খুব কাছের মানুষ। যার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’ গত এক বছরে পুলিশের এই সার্পোট সেন্টারের তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ২০ হাজার ৬৭৫ জন। এদের মধ্যে ১৫ হাজার ৩৭৮জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তার মধ্যে ৪ হাজার ৫৮৯ জন পরে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে জানা গেছে, এই অভিযোগের মধ্য থেকে ১০ হাজার পাচজনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। আর অবশিষ্ট ৭৮৪ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্য মতে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে ভুক্তভোগীর ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে ভুয়াসহ বেনামে আইডি খুলে সামাজিকভাবে হেনেস্থার অভিযোগ ৬ হাজার ৬৭৪টি, যা সাইবার অপরাধের ৪৩ শতাংশ। এছাড়া পূর্বের সম্পর্কের থেকে ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ ২ হাজার ৩৮৭টি, যা সাইবার অপরাধের ১৬ শতাংশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি হ্যাকসহ পাসওয়ার্ড চুরি করে একাউন্টের দখল নেওয়া অভিযোগ এক হাজার ৬৩৮টি। মোবাইল হ্যারেসমেন্টের অভিযোগ এক হাজার ৭৩৬টি। বিভিন্ন মাধ্যমে আপত্তিকর কন্টেন্ট পাঠানোর অভিযোগ এক হাজার ২৬৯টি। অন্যান্য অভিযোগ এক হাজার ৬৭৪টি। সাইবার অপরাধ নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করে। তার মধ্যে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন, সিআইডি সাইবার ক্রাইম। এই দুইটি ইউনিট সারাদেশে কাজ করলেও, ডিবি সাইবার ক্রাইম ও সিটি সাইবার ক্রাইম ঢাকা মহানগর নিয়ে কাজ করেন। এছাড়া কাজ করে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যা ব। এই সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে বলছে, সিআইডি সাইবার ক্রাইম ইউনিটে গত চার বছরে মামলা হয়েছে ৩৫৭টি; ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটে গত এক বছরে অভিযোগ পায় ১৭১টি ও গত তিন বছরে র্যা বে সাইবার অপরাধের মামলা হয়েছে ২৫৭টি। পরে র্যা ব সারাদেশে ২৬৫টি অভিযান চালিয়ে ৪৬০জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে করেন। তবে পুলিশে সাইবার নিয়ে অনেক আগ থেকে কাজ করে আসছে সিটি সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এই ইউনিটের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের থেকে ইমেইলে ৭৪৪টি, হ্যালো সিটি এ্যাপে ৬ হাজার ২০২টি আর ফেসবুক মনিটারিংয়ে ৩০ হাজার ৩৭৩টি অভিযোগ পেয়েছে। এই সব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৭৮টি। যার মধ্যে পুলিশ বাদি হয়েছে ৬৬টি মামলায়। এই সব মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪০১টি। এ ছাড়া ওই সব মামলায় সিটি গ্রেপ্তার করেছে ৪৯৭ জনকে। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইঞ্জিনিয়ার সাঈদ নাসিরুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরণ বদলাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন সব অপরাধের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। গত এক-দুই বছরে যেই অপরাধগুলো ঘটেছে। তার অধিকাংশই অনলাইনে।’ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাঈদ নাসিরুল্লাহ বলেন, ‘করোনার সময় থেকে ভুক্তভোগীদের ব্লাকমেইলিংয়ের অভিযোগ বেশি পেয়েছি। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন থেকেই এই সমস্যগুলো বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে ওই সময়ের তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি অনলাইনে ছেড়ে ব্লাকমেইলিং করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবচেয়ে ভয়ংকর যে অপরাধ ঘটেছে, তা হলো সাইরার বুলিং (ওপেন প্লাটফর্মে নেগেটিভ কমেন্ট)। অধিকাংশ সময় অনলাইনে থাকার কারণে সাইবার বুলিং বেড়েছেও অতিমাত্রায়। কমেন্ট করার ফলে যৌন হয়রানি ও উসকানিসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি থেকেই অপরাধ বেড়েছে।’ ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারাদেশের প্রতিটি থানায় এখন নারী ও শিশুদের জন্য সাইবার সেন্টার আছে। সেখানে এসে যে কেউ অভিযোগ দিতে পারেন। এই সেন্টারের দায়িত্বে থাকেন একজন এএসআই পদমর্যাদার অফিসারসহ দুই-তিন জন সদস্য। তবে পুলিশে সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অফিসার কম। যদিও এখন প্রতিনিয়ত অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের পক্ষ থেকে আমরা সব সময় ভুক্তভোগীর সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকে। এই ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা শুরুতে থানায় যেতে চান না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ আসার পর আমরা ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। প্রয়োজন অনুযায়ী মামলা, জিডি বা উপযুক্ত আইনি পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিই। ভুক্তভোগীর সঙ্গে থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি।’ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ জাকির হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ অন্য কোনো মাধ্যমে মানহানিকর বা অপমানজনক কোনো মন্তব্য করা অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এই ধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ এই আইনজীবী বলেন, ‘এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবার অভিযুক্তকে তিন বছর জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তির মাত্রাও বাড়বে। এছাড়া টেলিফোনে বিরক্ত করলেও তা টেলিযোগাযোগ আইনের ৭০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’