ঢাকা অফিস: সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিন আহমদ নিহতের ঘটনায় জড়িতদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার না করা হলে হরতাল, সড়ক অবরোধসহ বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দাবি করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের। নিহত রায়হান আহমদের পরিবার ও বৃহত্তর আখালিয়া এলাকাবাসীর উদ্যোগে আজ রোববার দুপুরে রায়হানের বাড়িতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। একই সঙ্গে এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফা দাবি জানানো হয়। এ সময় নিহত রায়হানের মা সালমা বেগমের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রায়হানের মামাতো ভাই শওকত আলী। দাবিগুলো হলো—রায়হান হত্যাকাণ্ডে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা, রায়হান হত্যায় জড়িত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা, পলাতক এসআই আকবর ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারে আইজিপির নির্দেশ প্রদান, পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য, নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা। সংবাদ সম্মেলনে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে কখনো কারো ঝগড়া-বিবাদ দেখিনি। আর ১০ হাজার টাকার জন্য যে আকবর আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে- এটা আমি বুঝতে পারছি না। সরকার তো তাদের লম্বা বেতন দিচ্ছে। তবে প্রথমদিন থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছে, নিশ্চয়ই এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে খুব বড় একটা কালোপাহাড় আছে। তা না হলে ১০ হাজার টাকার জন্য একটা জীবন নিতে পারে না।’রায়হানের মা আরো বলেন, ‘পুলিশের দায়িত্ব নয় যে একজনকে মেরে ফেলা। আর আমরা সবসময় পুলিশের ওপর আস্থা রেখে আসছি। আর এই পুলিশই যদি জীবন নিয়ে যায়, এটা কেমন করে হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত আসামিদের ধরে রিমান্ডে নেওয়া না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঘটনার সামনে-পেছনের কারণ বের হবে না। যারাই এ কাজ করেছে, সবাইকে আমি চিনি না। ওদের ধরে যতক্ষণ না পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত আমার ছেলের আত্মাও শান্তি পাবে না, এবং আমার মনেও শান্তি হবে না।’ সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান উদ্দিন আহমদকে (৩৩) গত ১০ অক্টোবর রাতে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। পরের দিন রোববার সকালে তাঁর লাশ পায় পরিবার। পরে ওই দিন রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারা এখন পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি। স্বজনদের অভিযোগ, ১০ হাজার টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশ হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার পর ১২ অক্টোবর ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে।
অতিরিক্ত আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু: গত ১৫ অক্টোবর রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘তিন সদস্যের একটি দল রায়হানের মরদেহের পুনরায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা বলেছি, আসলে অতিরিক্ত আঘাতের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’ ‘এর আগে গত ১১ অক্টোবর প্রথম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। এবং প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন শুক্রবার আমরা কোতোয়ালি থানায় দাখিল করেছি’, যোগ করেন চিকিৎসক।
মামলা পিবিআইয়ে, ইমিগ্রেশনে নির্দেশনা: রায়হান উদ্দিন আহমদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের প্রধান, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমাদের মনে হয়েছে, সিলেট কোতোয়ালি থানার বন্দর বাজার ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে আমাদের দরকার। সেজন্য আমরা সমগ্র ইমিগ্রেশনে জানিয়ে দিয়েছি, যাতে তিনি পাসপোর্ট নিয়ে পালাতে না পারেন।’
পলাতক এসআই আকবর: এদিকে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া হঠাৎ করেই পুলিশের নজরদারির বাইরে চলে গেছেন। তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসআই আকবর যাতে পালিয়ে ভারতে চলে যেতে না পারেন- এজন্য সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী সব থানা এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, গত ১২ অক্টোবর রাত ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এসআই আকবর পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। তখন তিনি নগরীর জিন্দা বাজার এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এরপর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ দেখাচ্ছে। তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
‘ফাঁড়িতে টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন রায়হান’: আলোচিত এই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার বিকেল ৩টায় রায়হান উদ্দিন আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন তিনি। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তাঁরা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান। এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’