‘শেষ ইচ্ছা’য় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন!

0

ঢাকা অফিস: ‘অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সে দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হলো!এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি আমার ছেলেকে চাকরি ও বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে। তাই মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ হিসেবে তাদের স্যালুট আমার শেষ যাত্রায় চাই না।’ মৃত্যুর দুই দিন আগে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে এক চিঠিতে কথাগুলো লেখেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে চিঠিতে উল্লেখ করা ‘শেষ ইচ্ছা’ অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ইসমাইল হোসেনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। এসময় ‘গার্ড অব অনার’ দিতে আসা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের ফিরিয়ে দেন ইসমাইল হোসেনের স্বজন-পরিজনেরা। মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন দিনাজপুর সদর উপজেলার ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ে বিউগলে বাজেনি বিদায়ের সুর। এমনকি তার মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিতও করা হয়নি। পরিবার ও স্বজনেরা জানান, গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি চিঠি লিখেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। পরে এর নিচে সইও করেন। ওইদিনই তা ডাকযোগে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের ঢাকার ঠিকানায় পাঠানো হয়। এর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ১১টায় মারা যান জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। জানাজার নামাজ শুরুর আগে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য হাজির হন। কিন্তু মৃত্যুর আগে চিঠিতে উল্লেখ করা ‘ইচ্ছা’ অনুযায়ী এই অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিতে দেবেন না বলে জানান তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের লেখা চিঠির মূলকথা হলো, গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে তার ছেলে নূর ইসলাম ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে এসিল্যান্ডের গাড়িচালকের চাকরি পান। কিছুদিন আগে কর্মস্থলের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানাতে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন নূর ইসলাম। এসময় হুইপ সমস্যার বিষয়গুলো দেখার জন্য এডিসিকে (রাজস্ব) নির্দেশ দেন। এরপর হঠাৎ নূর ইসলামকে তার বসবাসরত ‘খাস পরিত্যক্ত’ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মুক্তিযোদ্ধার চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে নুর ইসলামকে বাথরুম পরিষ্কারের পর মাংস রান্না করতে বলেন এসিল্যান্ডের স্ত্রী। এরপর সেদিন মাংস রান্না হয়নি—এমন অভিযোগ এনে নুর ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সঙ্গে দেখা করতে যান নুর ইসলাম। এসময় জেলা প্রশাসকও নুর ইসলামের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।  চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এর দুয়েক দিন পর এসিল্যান্ডের স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য যান নূর ইসলাম। এসময় তার সঙ্গে ছিল স্ত্রী ও সন্তানেরাও। ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও তারা এসিল্যান্ডের স্ত্রীর দেখা পাননি। চাকরি চলে যাওয়ায় আর কোনও উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে ফের দেখা করেন নূর ইসলাম। এ বিষয়কে আরও নেতিবাচকভাবে নেয় প্রশাসন। পরে চাকরি ও থাকার জায়গা হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন নূর ইসলাম। চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন লিখেছেন, ‘অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সে দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হলো! ২১ অক্টোবর থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগে (ওয়ার্ড-২, বেড-৪৪) চিকিৎসাধীন আছি। এখানে থেকেই এই পত্র তোমার কাছে (হুইপ ইকবালুর রহিম) লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন, তুমি ন্যায়বিচার করো। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার বয়স প্রায় ৮০ বছর। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। ছেলে হঠাৎ চাকরিচ্যুত হওয়ায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমি। মৃত্যু হলে আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ, এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি—যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত-বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/স্যালুট আমার শেষযাত্রায় আমি চাই না।’ জানাজার আগে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের পরিবার-পরিজনের পক্ষে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোফাজ্জল হোসেন দুলাল বলেন, ‘অন্যায়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের ছেলেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি চিঠি লিখে গেছেন। আমরা তার লিখে যাওয়া চিঠির ওসিয়ত অনুয়ায়ী তাকে দাফন করতে চাই। চিকিৎসার জন্য তিনি অনেকের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন।’ গার্ড অব অনার দিতে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে ইসমাইল হোসেনের ছেলেরা বলেন, ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বেতন পান। একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি এমন অবহেলা, এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে। এই কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করেছেন।’ এ ব্যাপারে দিনাজপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু সালেহ মো. ফাহফুজুল আলম বলেন, নূর ইসলাম এসিল্যান্ডের অস্থায়ী গাড়িচালক ছিলেন। কিন্তু, এসিল্যান্ড তার কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাকে মাদকাসক্ত মনে করেছেন এবং গাড়ি চালনার সময় নিরাপদ মনে করতেন না। পূজার সময় দায়িত্ব দেওয়া হলেও নূর ইসলাম আসেননি এবং মোবাইলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এই ঘটনায় তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সেখানে তিনি কীভাবে ছিলেন তা জানা নেই তবে সেটি তাকে লিজে দেওয়া ছিল না। তাই চাকরি যাওয়ার পর তাকে বাড়ি ছাড়তে বলা হয়েছে। চাকরিচ্যুতের বিষয়টি হুইপকে জানানো অপরাধ ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোটেও বিষয়টি এরকম নয়। এসব ব্যাপারে এসিল্যান্ড সাহেব ভালো বলতে পারবেন। যোগাযোগ করা হলে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নূর ইসলামের চাকরি স্থায়ী ছিল না। এছাড়া, গাড়ি চালানোয় সে দক্ষ ছিল না; কয়েকবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।’ চাকরিচ্যুতের বিষয়টি জানেন না দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’ জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রশাসন থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়ার পর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হই। পরিবারের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দিতে বাধা দেওয়ায় তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।’  এ বিষয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

Share.