জমি ও অর্থ সংকটে ৫৬০ মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ আটকে আছে

0

ঢাকা অফিস: দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে তিন বছরেও জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। এতে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই তড়িঘরি করে ৫১৫টি মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর গণপূর্ত। এখন কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সংস্থাটি। বছরের পর বছর পার হলেও কাজের অগ্রগতি সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মসজিদ নির্মাণে জমি সংকটের পাশপাশি অর্থের সংকটের কারণে উন্নয়ন কাজ পিছিয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে মসজিদ নির্মাণের সময় নির্ধারণ করা হলেও যে গতিতে কাজ চলছে তাতে আগামী বছরেও  মসজিদ নির্মাণ সম্ভব হবে না। গত ২৭ আগস্ট তারিখ ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন দেখা গেছে, মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপনে এখনও ৭৯টি এলাকায় জমি মেলেনি। অনেক এলাকায় জমি মিললেও জমি হস্তান্তরে বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। মসজিদ নির্মাণে জমি ক্রয়ের অর্থ পরিশোধ করলেও মামলার কারণে নির্মাণ কাজ আটকে আছে। তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। চারতলা মডেল মসজিদ ‘এ’ ক্যাটাগরি আয়তন হবে দুই লাখ ৮১ হাজার বর্গমিটার। এক লাখ ৬৪ হাজার ৭৪২ বর্গমিটার আয়তনের বি-ক্যাটাগরি এবং সি ক্যাটাগরি মসজিদের আয়তন ৬১ হাজার ২৫ বর্গমিটার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হলেও জমি সংকটে বেকায়দায় পড়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তর। এখন নির্মাণ কাজ নিয়ে শুরু হয়েছে নানান তাল-বাহানা। নির্মাণ কাজে এসেছে ধীরগতি। জমি নির্ধারণের আগেই গণপূর্ত অধিদপ্তর তড়িঘরি করে কাজের দরপত্র আহ্বান করায় এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক ‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে’ ৮ হাজার ৭২২ কেটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের এপ্রিল হতে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নে অনুমোদিত করা হয়। প্রতিটি মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র ৪০ শতাংশ জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। চার তলার জন্য কমবেশি ১৫ কোটি টাকা এবং তিন তলার জন্য কমবেশি ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের জন্য জায়গা নির্ধারণের দায়িত্ব মূলত সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের। জমি নির্ধারণের পরেই নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান ও সর্বনিম্ন দরদাতা কার্যাদেশ পাবেন। কিন্তু গণপূর্তের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জমি নির্ধারণের আগেই তড়িঘড়ি করে দরপত্র আহ্বান করেন। এই কারণে নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ৫৬০ মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম  বলেন, মসজিদ নির্মাণে গণপূর্ত অধিদপ্তর দরপত্র আহ্বান করেছে। এখানে ইসলামি ফাউন্ডেশনের সম্পৃক্ততা নেই। ভবন নির্মাণে জমি পাওয়া গিয়েছিল,  সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) হয়েছে কিন্তু জমি দখল পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত ৪১২টি মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়েছে। প্রকল্প মোট ব্যয়ের তুলনায় কাঙ্খিত বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। চলতি বছর ১শ’ মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। সেজন্য ২ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও কম বরাদ্দ পেয়েছি। সঠিক বরাদ্দ পেলে প্রকল্পের কাজে আরও গতি আসবে। মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কথা বলা নিষেধ। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি আর কথা বলতে চান না। জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই ৫১৫টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের মুখপাত্র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী গণপূর্ত প্রজেক্ট সার্কেল-২ এর মোহাম্মদ পারভেজ খাদেম বলেন, ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্রের জমি ধর্ম মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা করবে। আর গণপূর্ত অধিদপ্তর অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে। তবে নির্মাণের কাজ চলমান রাখতেই জমি অধিগ্রহণের আগেই দরপত্র আহ্বান করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এখন পর্যাক্রমে জমি নির্ধারণ হচ্ছে, পর্যাক্রমে কাজ চলছে। জমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে নিয়েও আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, মসজিদ নির্মাণে সরকারি জমি ছাড়াও অনেকে ব্যক্তি জমি দান করেছেন। প্রকল্পের আওতায় কিছু জমি কেনা হয়েছে। জেলাগুলোতে বেশকিছু মসজিদ চার তলা এবং উপজেলায় তিন তলার অবকাঠামোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী  আরও বলেন,  ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতি কেন্দ্রের মধ্যে ৫১৫টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাকি ৪৫টির দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হয়নি। ৫১৬টি মসজিদের কমবেশি ৩শ’ মসজিদের কাজ চলমান রয়েছে। আর কমবেশি ১শ’ মডেল মসজিদ নির্মাণে জমি সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ এলাকায় জমি চিহ্নিত হওয়ার পরেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। জমি চিহ্নিত হওয়ার পর কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মসজিদের জন্য নির্ধারিত জমি পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত তিন বছরেও জমির সংকট দূর হয়নি। একইসঙ্গে যেসব মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়েছে, অধিকাংশই শর্ট কলাম ঢালাই বা ১ম তলার কলাম ঢালাই শেষ। তবে কিছু সংখ্যক মসজিদের তিন তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ১০৩টি মসজিদ নির্মাণ কর হবে। কিন্তু জমি সংকটে মসজিদ নির্মাণ কাজ পিছিয়ে পড়ছে। গত তিন বছরেও ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনে তিনটি মসজিদ নির্মাণের জমি মেলেনি। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিভাগের আরও যেসব কিছু এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি পাওয়া যায়নি সেগুলা হল- ধামরাই, কেরাণীগঞ্জ-৩, গাজীপুর সদর উপজেলা, কালীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ জেলা সদর, কাশিয়ানী, কোটালীপাড়া, নিকলি, কিশোরগঞ্জ মিঠামইন, মাদারীপুর কালকিনি, মানিকগঞ্জ সিংগাইর, মুন্সীগঞ্জ জেলা সদর, মুন্সীগঞ্জ গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ লৌহজং, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা, ঘাটাইল, গোপালপুর, মধুপুর, মির্জাপুর, নাগরপুর, নরসিংদী জেলা সদর, বেলাব, রায়পুরা, রাজবাড়ী বালিয়াকান্দি। কিশোরগঞ্জ জেলা সদর শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে স্থানীয় লোকজনের আপত্তির জন্য কাজ বন্ধ। অষ্টগ্রাম স্থানীয় লোকজনের আপত্তিতে, সেখানেও মসজিদে নির্মাণের কাজ বন্ধ আছে সেজন্য মসজিদ নির্মাণের জমি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। টাঙ্গাইল ভূঞাপুর মসজিদ নির্মাণে জমি নিয়ে মামলা চলছে। ঢাকা বিভাগে মোট ৩০টি এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি পাওয়া যায়নি।  রাজশাহীতে ৭৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু জমি সংকটে সেখানেও মসজিদ নির্মাণের কাজে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগে যেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণের জমি মেলেনি তা হল- বগুড়া শাজাহানপুর, নাটর সদর উপজেলা, পাবনা জেলা সদর, সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি, চৌহালী, কামারখন্দ, উল্লাপাড়া, রাজশাহী জেলা সদর-১। সর্বমোট ৮টি এলাকায় জমি পাওয়া যায়নি। রংপুর বিভাগে মোট ৬৬টি মসজিদ নির্মাণের কথা রয়েছে। এখনও যেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি পাওয়া যায়নি তা হল- দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ, বোচাগঞ্জ, কাহারুল, কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী, চর রাজিবপুর, লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী, রংপুর জেলার পীরগাছা। মোট ৭টি এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি মেলেনি। ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯টি এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণের কথা থাকলেও শেরপুর জেলা সদর, নকলা এবং ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরে জমি পাওয়ায় যায়নি। এখানে মোট ৩টি এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি মেলেনি। বরিশাল বিভাগে ৪৮টি এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু জমি সংকটের কারণে এই বিভাগে মসজিদ নির্মাণ বিভিন্ন এলাকায় আটকে আছে। বরিশাল বাবুগঞ্জ, ভোলা জেলা সদর, ঝালকাঠি জেলা সদর, কাঠালিয়া, পটুয়াখালীর গলাচিপা, মির্জাগঞ্জ, উজিরপুর মসজিদের জমি নিয়ে মামলা চলছে। মোট ৭টি এলাকায় জমি মেলেনি। চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৫টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এই বিভাগে যেসব এলাকায় এখন জমি পায়নি তা হল- চট্টগ্রামের আনোয়ারা-২ এলাকায় টেস্ট পাইল ঢালাই সম্পন্ন কিন্তু জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, ফটিকছড়ি-২, হাটহাজারী-২, কুমিল্লা জেলার তিতাস, ফেনী জেলার দাগনভূইয়া এলাকায় মসজিদের জমি নিয়ে মামলা চলতে কিন্তু সেখানে জমি অধিগ্রহণের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে, ফেনী পরশুরাম ও সোনাগাজী এলাকায় মসজিদের জমি নিয়ে মামলা চলছে। লক্ষ্মীপুর রায়পুর এলাকায় জমি পাওয়া যায়নি, রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি ও সদর উপজেলায় জমি অপর্যাপ্ত। মোট ১১টি এলাকায় জমি মেলেনি। খুলনা বিভাগে ৭০টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এই বিভাগের যেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি পায়নি তা হল- বাগেরহাট জেলা সদর, সদর উপজেলা, কচুয়া ও মোড়েলগঞ্জ জমি নিয়ে মামলা চলছে, মাগুরা সদর উপজেলা, মুহাম্মদপুর, সাতক্ষীরা জেলা সদর জমি নিয়ে মামলা চলছে, তালা এলাকায় জমির সমস্যা আছে। মোট ৮টি এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমি মেলেনি। সিলেট বিভাগেও ৪৩টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু এখনও এই বিভাগে মসজিদ নির্মাণে জমির সমস্যার সমাধান হয়নি। সিলেট বিভাগে যেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণে জমির সংকট রয়েছে তা হল- মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, জুড়ি, সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার, জৈস্তাপুর ও কোম্পানিগঞ্জ মসজিদ নির্মাণে টেস্ট পাইল ড্রাইভ সম্পন্ন হলেও মামলার কারণে কাজ বন্ধ আছে। মোট ৫টি এলাকায় মসজিদ নির্মাণের জমি মেলেনি।

Share.