খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি

0

ঢাকা অফিস: নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই হাজার ১২৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা রকম সুবিধা দিয়েও ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ আবারও এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন করে কোনো সুযোগ না দিয়ে ঋণ আদায়ে কঠোর হতে হবে ব্যাংকগুলোকে। তবে ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ঋণের টাকা আদায়ে ব্যাংকগুলোর বিশেষ কোনও উদ্যোগ না থাকার কারণে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এর আগে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। নতুন যে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তার মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে, সরকারি ব্যাংকে বেড়েছে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই পরিমাণ বাড়ার কারণে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণকে ছাপিয়ে গেল বেসরকারি ব্যাংক। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার তিন গুণেরও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকে যত ঋণ বিতরণ হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই খেলাপি হয়ে আছে। আর এক বছরে অনেকটা বাড়লেও বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ৫ শতাংশের কিছু বেশি। এই এক বছরে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির অবনতি হলেও বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পেরেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও না বাড়ার ঘোষণা দিয়ে ঋণ নিয়মিতকরণ করতে নানা সুবিধা ঘোষণা করেন। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুবিধা দেয়া হয় শুরুতে। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়। ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর কিস্তি না দিয়েও খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধা দেয় হয়। পুরো বছরই চালু থাকে এই সুবিধা। ২০২১ সালের শুরুতে কিস্তি না দিয়ে খেলাপিমুক্ত থাকার ঢালাও সুবিধা কিছুটা কমানো হয়। সে বছর নানা সময় কিস্তিুর একাংশ জমা রাখলেই খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেয়া হয়। প্রথমে বলা হয়, ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করেই খেলাপি হবেন না গ্রাহক। তবে করোনার সময় ব্যবসা বাণিজ্যের সমস্যার কথা বলে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে জমা করার পরিমাণ কমানো হয়। সবশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণের কিস্তির ১৫ শতাংশ জমা দিলে খেলাপি না করার নির্দেশনা ছিল, যার মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ সুবিধা আরও ২০ দিন মৌখিকভাবে বাড়িয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ও বেসিকে এ ছয় ব্যাংক মোট ঋণ বিতরণ করে ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। এক বছরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ছিল ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। ওই সময় বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো গত বছর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা এই লাফ দেয়ায় এখন সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ টাকার অঙ্কে বেশি। তবে শতকরা হারের দিক দিয়ে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সরকারি ব্যাংকের তুলনায় কম। মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ খেলাপি হয়ে আছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত কৃষি, প্রবাসীকল্যাণ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন এ তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৩ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০২ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। আগের বছর এই ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল ৪ হাজার ৬২ কোটি। অর্থাৎ এই ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিদেশি মালিকানার নয় ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ হয় ৬৪ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। আগের বছর এই নয় ব্যাংকে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ছিল ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই এক বছরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৫৩ কোটি টাকা বা ৩৭ শতাংশ। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় পদক্ষেপ এবং কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকে যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দেওয়ার বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দিলে খেলাপি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

Share.